
Home রাজনীতিবিদ / Politicians > খান বাহাদুর লুৎফর রহমান / Khan Bahadur Lutfor Rahman
এই পৃষ্ঠাটি মোট 17478 বার পড়া হয়েছে
খান বাহাদুর লুৎফর রহমান / Khan Bahadur Lutfor Rahman
খান বাহাদুর লুৎফর রহমান
Khan Bahadur Lutfor Rahman
Home District: Jessore
Khan Bahadur Lutfor Rahman
Home District: Jessore

যশোহরের যশস্বী ও জ্ঞানী কুলের শিরোমনি খান বাহাদুর লুৎফর রহমান যশোর শহরের অন্তর্গত খোলাডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুন্সী ফজলুর রহমান যশোর দেওয়ানী আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন / সিভিল কোর্টের নায়েব নাজির ছিলেন। তিনি খোলাডাঙ্গা ও তৎসংলগ্ন অনেক গ্রামে বহু সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। মুন্সী ফজলুর রহমানের পিতা মরহুম মুন্সী দেরাজতুল্লাহ বিশ্বাস একজন অতি ধার্মিক ও সাধক প্রকৃতির লোক ছিলেন। দেরাজতুল্লাহ বিশ্বাস যশোহর জেলার কেশবপুর উপজেলাধীন বেগমপুর গ্রামের আদি অধিবাসি ছিলেন। তিনি প্রথম অবস্থায় যশোর সিভিল কোটের রাইটার ছিলেন। চাকরিসূত্রে তিনি যশোর শহরের প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে খোলাডাঙ্গা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তিনি অত্যন্ত দানশীল ও সুফী ধরনের মানুষ ছিলেন। সমসাময়িককালের গ্রাম্য লোকদের কাছে জানা গেছে যে, মরহুম দেরাজতুল্লাহ বিশ্বাসের বাড়ী থেকে কোন লোক অভুক্ত অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি।
লুৎফর রহামান যশোর শহরতলী বাহাদুরপুর নিবাসী জানাব মতিউর রহমান সাহেবের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি ৬ সন্তানের জনক ছিলেন। সেজ ছেলে জনাব লতিফুর রহমান ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং ২০০১ সালে নিরদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
খান বাহাদুর লুৎফর রহমান যশোর জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। তিনি যশোর জিলা স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর ছাত্র হিসেবে প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করার পর তিনি কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই. এ এবং বি. এ পাশ করেন। আরবী ও ফারসী ভাষায় তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তিনি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ছিলেন। বি. এ পাশ করার পর কলকাতা মাদ্রাসায়ও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করার পর ১৯২০ সালে যশোর জেলা বারে উকিল হিসাবে যোগদান করেন। লুৎফর রহমান যশোর জেলার খ্যাতনামা দুইজন হিন্দু উকিলের চেম্বারে শিক্ষানবীশ হিসাবে কাজ করেন এবং পরে নিজে ওকালতি পেশা শুরু করেন অতঃপর যশোর বারে যোগদান করেন। সেই সময় হিন্দু আইনজীবীরাই বারের উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তাদের সাথে ওকালতি ব্যবসা করে অতি অল্প সময়ে তিনি নিজেকে একজন যোগ্য আইনজীবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
জনাব লুৎফর রহমান ও পাবনার দেওয়ান লুৎফর রহমান অতিরিক্ত জেলা জজ হিসাবে একত্রে মনোনয়ন পান কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি তা গ্রহণ করেন নি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সে সময় লুৎফর রহমান সাহেব আইন পাশ করেন তখন চাকরির দিকে মুসলমান ছেলেদের একটা সহজ ও স্বত:ফুর্ত ইচ্ছা থাকত। লুৎফর রহমান সাহেব আইন পাশ করার পর পর Sub-Deputy Magistrate এর মনোনয়ন পান। কিন্তু তিনি সেটাও তিনি গ্রহণ করেননি কারণ তিনি Deputy Magistrate এর মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সেই জন্য তিনি পরবর্তীকালে আইন ব্যবসাই বেছে নিলেন।
জনাব রহমান প্রথম দিকে যশোর বারের পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন এবং পরবর্তীকালে সরকারী উকিলের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সততা ন্যায়নিষ্ঠ, ও বিচক্ষণতার সাথে মামলা পরিচালনা করতেন। তিনি আইনজীবি হিসেবে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আইন পেশায় যে সততা লুৎফর রহমান সাহেব রেখে গিয়েছেন তাঁর দৃষ্টান্ত বিরল।
১৯৫৫ সালে জনাব লুৎফর রহমানের চোখ নষ্ট হয়। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং প্রায় ৫/৬ মাস সেখানে অতিবাহিত করেন। একটু সুস্থ্য হলে ১৯৫৭ সালে আবার যশোরে ফিরে আসেন কিন্তু দৃষ্টিশক্তি পুরাপুরি আর ফিরে পান নি, যার জন্য তিনি পড়ালেখাও করতে পারতেন না। তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ অবস্থায়ও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মামলা পরিচালনা করতেন। তাঁর জুনিয়রদের কাছ থেকে মামলার বিবরণ শুনে এবং রেফারেন্স স্বরূপ ডি. এল. আরও অন্যান্য আইন পুস্তক শুনে মামলা পরিচালনা করতেন। তিনি নিজে না পড়ে যেভাবে মামলা পরিচালনা করতেন তা অবিশ্বাস্য বলে মানে হত। তিনি এই সময়ের মধ্যে অত্যন্ত বড় বড় সেশনস্ মামলা, আপীল, জটিল আদিম দেওয়ানী মামলা / দেওয়ানী আপীল, নিজে জুনিয়রদের সহযোগিতায় পরিচালনা করতেন। লুৎফর রহমান সাহেবের মামলা পরিচালনা দেখে অনেক জেলা জজ মনে করতেন যে, তিনি হয়তো চোখে দেখেন এবং পড়তে পারেন। চেখে না দেখে একজন যে এতো সুন্দার মামলা পরিচালনা করতে পারেন তা অনেকেই বিশ্বাস করতেন না। ১৯৫৭ সাল থেকে প্রায় ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ ২১ বৎসর তিনি একজন অন্ধ লোক হিসাবে পুরাপুরি আইন ব্যবসা পরিচালনা করেন।
লুৎফর রহমান সাহেবের যশোহর জেলা বারে ওকালতি জীবনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং সেই অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্মান প্রদান করা হয়।
রাজনৈতিক জীবন:
জনাব লুৎফর রহমান আইনজীবি হিসাবে পরিচিতি লাভ করার সাথে সাথে তিনি রাজনীতিতে যোগদান করেন। বহু দিন যশোহর মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং কয়েকবার তিনি যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যন পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে বঙ্গীয় পরিষদ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী মরহুম নওশের আলী সাহেবকে পরাজিত করেন এবং বঙ্গীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে লুৎফর রহমান সাহেবের একটি চোখ নষ্ট হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তিনি নির্বাচনে নেমে পড়েন এবং পরবর্তীতে জয়লাভ করেন। এটা লোক মুখে শোনা গেছে যে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলতেন যে লুৎফর রহমান সাহেব ছাড়া কংগ্রেস প্রার্থীকে হারানো যাবে না। লুৎফর রহমান সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠার জন্য তাঁকে প্রথমে বৃটিশ গর্ভমেন্ট খান সাহেব উপাধি দেন এবং পরে খান বাহাদুর উপাধিতে ভুষিত করে।
জনাব লুৎফর রহমান সাহেব অনেক সামাজিক হিতৌষীকার ও জনকল্যাণ মূলক কর্মকান্ডের শহীদ বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় পরিষদের সদস্য থাকাকালীন সময়ে নিজের জন্য অথবা নিকট আত্মীয়-স্বজনের জন্য কোনদিন কোন সুবিধা গ্রহণ করেননি। তিনি মানব কল্যাণে অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু নিজের জন্য এক খন্ড জমিও গ্রহণ করেননি।
লুৎফর রহমান সাহেবের সাথে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব, বঙ্গীয় নেতা হোসেন সহিদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব, বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ, বিচারপতি বাকের, প্রধান বিচারপতি মাহমুদ হোসেন প্রমুখের সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে লুৎফর রহমানের বাসায় অতিথি হিসাবেও থেকেছেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য:
জনাব লুৎফর রহমান অত্যন্ত মহৎ হৃদয়ের একজন মানুষ ছিলেন। তিনি সদালাপী ছিলেন এবং সকলের সংগে অত্যন্ত আপনভাবে মেলামেশা করতেন। মানুষের উপকার করার একটা স্বভাবজাত প্রবৃত্তি ছিল তাঁর। কোন লোক সাহায্যের জন্য আসলে তিনি কখনই ফেরাতেন না। আর্থিক বা অন্য কোন উপায়ে তাকে সাহায্য করবার চেষ্টা করতেন।
পরলোক গমন:
জনাব লুৎফর রহমান ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিকাল ৫ ঘটিকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে খড়কী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
তথ্য সূত্র:
লতিফুর রহমান
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট:
মার্চ ২০১২