
Home ঐতিহ্য (Tradition) > প্রশাসনিক ক্রমবিন্যাস- আপডেট চলছে
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86776 বার পড়া হয়েছে
প্রশাসনিক ক্রমবিন্যাস- আপডেট চলছে
সাধরণ প্রশাসন :
বর্তমান যশোর অঞ্চলের প্রথক কিন্তু তথ্যবহুল প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কিত সঠিক দলিল এযাবৎ পাওয়া যায়নি। পুরাতন গল্পকাহিনী ও কিংবদন্তি-নির্ভর ইতিহাস থেকে ধারণা লাভ করা যায় যে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত যশোর অঞ্চল গুপ্ত বংশীয় রাজাদের শাসনাধীন ছিল। গুপ্ত শাসনের অবসানের পর বাংলার অংশ হিসাবে যশোর অঞ্চল ৫৭৫সাল পর্যন্ত ¯^vaxb ও শক্তিশালা রাজাদের অধীনে ছিল। এরপর যশোর ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত শশাংক, হর্ষবর্ধন ও অন্যান্য রাজাদের অধিকারে ছিল।
মুসলমানদের শাসনাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় পাঁচশ বছর পাল (৭৮১-১০৮০), বর্মন (১০৮০-১১৫০)সাল এবং সেন (১১৫০-১৩০০) বংশীয় রাজাগল যশোর অঞ্চল শাসন করেন।২
ত্রয়োদশ মতাব্দীর শেষের দিকে সুলতান মুঘিসুদ্দিন তগরাল-এর সময় (১২৬৮-১২৮১সাল) যশোর অঞ্চ মুসলমানদের শাসনাধীন হয়ে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এ সময়কাল সুলতানী আমল হিসাবে ইতিহাস খ্যাত।
সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা প্রশে মোঘল সাম্রাজের অধীনে চলে এলেও বাংলার বার ভূঁইয়ারদের অন্যতম জামিদার প্রতাপাদিত্য প্রদত্ত বিরোধিতার কারণে ১৬১২সাল পর্যন্ত যশোর মোঘল শাসনের অধীনে আসতে পারেনি। অর্থাৎ সম্রাট জাহাংগীরের আমলে বাংলার শক্তিধর গভর্ণর ইসলাম খান-এর সময় যশোর মোঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ব অধিক্ষেত্র : যশোর জেলা ১৭৬৫ সালের ১২ই আগস্ট মোঘল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় কর্তৃক প্রদত্ত দিওয়ানীর আওতায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনধীনে আসে।৫ ইউসুফপুর ও সৈয়দপুর পরগণাদ্বয়ের অন্তর্গত ১৩৬৫বর্গমাইল এলাকা সংলগ্ন যশোর (বর্তমান যশোর জেলার বেশিরভাগ অংশ), খুলনা (বর্তমান খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা) এবং ২৪ পরগনা (বর্তমান ভারতের পশ্চিম বংগের একটি অংশ) নামক অঞ্চলগুলো নিয়েই গঠিত হয়েছিল তখনকার যশোর জেলা। ১৭৯৩সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গঠিত হয়েছিল হওয়ার সময়ে যশোর জেলাকে পুনর্গঠিত করা হয়। এর ফলে যশোর সদর মহকুমা (বর্তমান যশোর জেলা), খুলনা সদর মহকুমা (বর্তমান খুলনা জেলা), ফরিদপুর (বর্তমান গোপালগঞ্জ ও রাজশাহী জেলা) এবং কুষ্টিয়া (বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা) অঞ্চল পুনর্গঠিত যশোর জেলায় চলে আসে।
বৃটিশ শাসন ও অধিক্ষেত্রের পরিবর্তন:- পৃথক জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর হতে বিভিন্ন সময়ে যশোর এর আয়তন ও সীমানায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৭৮৬সালে যখন জেলার জন্য একজন কালেক্টর নিয়োগ করা হয় তখন বিচার প্রশাসন পূর্বতন অর্থাৎ বৃহত্তর ফরিদপুর, বৃহত্তর যশোর এবং আছামতি নদীর পূর্বপার্শ্বস্থ ২৪-পরগণা জেলার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছিল। ১৭৯৩সালে ভূষণাকে যশোরের সংগে যুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে নোয়াপাড়া ও কুষ্টিয়া মূর্শিদাবাদ হতে আলাদা করে যশোরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৭৯৪সালে যাউদিয়া ও গজনবীপুর পরগণাদ্বয়কে যশোর থেকে আলাদা করে নদীয়ার সংগে জুড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ঝিকরগাছা হয়ে যায় যশোরের পশ্চিম দিকের সীমান্ত ১৭৯৯সালে নদীয়ার মির্জানগরকে যশোরের সংগে যুক্ত করা হয়। ১৮১২সালে চান্দা ও বলেশ্বর নদীকে পূর্ব-সীমানা হিসাবে নির্ধারণ করা হয় এবং টাকি থানাকে নদীয়ার সংগে দেওয়া হয়। সীমানা পরিবর্তনের সংগে সম্পর্কযুক্ত একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা ঘটে ১৮১৪সালে যখন যশোরকে ফরিদপুর থেকে পৃথক করা হয়। ১৯২৮সালে কয়েকটি থানা যেমন- ধর্মপুর (পাংশা), কুষ্টিয়া, মধুপুর এবং খোকশাকে পাবনার সংগে যুক্ত করা হয়।
নীল বিদ্রোহ দমনের কৌশল হিসাবে ১৮৬০-৬১সালে যশোর জেলাকে কয়েকটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়। মহকুমা গুলো হলঃ খুলনা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল ও যশোর। ১৮৬১সালে কচুয়া থানাকে বাকেরগঞ্জ থেকে আলাদা করে যশোর-এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৮২সালে খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমাকে যশোর থেকে পৃথক করা হয়। ১৮৮৩সালে বনগাঁ মহকুমাকে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিম বংগের নদীয়া জেলার অন্তর্গত) যশোর-এর সংগে যুক্ত করা হয়। বৃটিশ সরকার প্রত্যক্ষ শাসন-ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ১৭৮১সালে একটি আদালত স্থাপনের মাধ্যমে মুড়লীকেই যশোরের সদর দপ্তর করা হয়েছিল। ১৭৯০সালে যশোর-এর সদর দপ্তর মড়লী থেকে দু-মাইল উত্তরে বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসনের শুরু :- যশোর অঞ্চল ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত ইঙগ-মোঘল যৌথ শাসনাধীন ছিল। ওয়ারেন হ্যাস্টিংস ১৭৭২সালে বাংলার গভর্নর হওয়ার পর ¯^í সময়ের জন্য একজন ইউরোপীয়কে যশোর-এর কালেক্টর হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন।১ তাঁর কার্যকাল ১৭৭২ থেকে ১৭৭৪ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দেওয়ানী আদালতের বিচারকের ক্ষমতাসম্পন্ন এই কালেক্টরের কার্যালয়টি ১৭৭৪সালে বিলুপ্ত করা হয়। একই ব্যক্তিকে একাধারে জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৭৮১সালের মে মাসে টিলম্যাণ হেংকেল যশোরের একটি কালেক্টরেট স্থাপিত হয়েছিল এবং হেংকেল কালেক্টর হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইতোপূর্বে জেলার পূবাঞ্চল ব্যতীত যশোরের অন্যান্য এলাকার রাজস্ব প্রশাসনের সদর দপ্তর ছিল কলকাতা। হেংকেল সাহেব রাজস্ব প্রশাসনের কিছু অসুবিধা দুর করার নিমিত্ত বিনা অতিরিক্ত বেতনে কালেক্টরের দায়িত্ব পালন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠালেন। সরকার কর্তৃক তার প্রস্তাব তাৎক্ষনিকভাবে গৃহীত হয় এবং যশোরের জন্য একটি কালেক্টরেট সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে ইছামতী নদী ও বাকেরগঞ্জ জেলার (পূর্বে যা ঢাকার অংশ ছিল) মধ্যবর্তী ইউসুফপুর এবং সায়েদপুর জমিদারীদ্বয়, যে এলাকাগুলোর রাজস্ব আদায়ের সদর দপ্তর ছিল যথাক্রমে কলকাতা ও হুগলী, যশোর কালেক্টরেটের অধীনে চলে আসে।২
ভূমি রাজস্ব পরিশোধ নিশ্চিত করার নিমিত্ত কালেক্টর ক্রমাগত খেলাপী রাজস্ব দাতাদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করতেন। খেলাপীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। আইনানুগ শাস্তি হিসাবে ‘খেলাপীদের-জেল’-এ অন্তরীণ রাখার ব্যবস্থাও ছিল। কলেক্টর একদিকে যেমন যে কোন জমির খাজনা সরাসরি গ্রহন করতেন, অন্যদিকে যে কোন সম্পত্তির উপর নতুন খাজনা আরোপ করতে পারতেন। জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে ১৭৯৩ কালেক্টরের কার্যালয়টিকে পৃথক করা পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে উপরোক্ত পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।
লর্ড কর্ণওয়ালিশ আনীত সংস্কার গুলো ব্রিটিশ প্রশাসনকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিল। তাঁর আমলেই দারোগার পদটি বিলুপ্ত করে ম্যাজিস্ট্রেটকে ছোটখাট যাবতীয় ফৌজদারী মামলা বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ঘৃন্য অপরাধীদের বিচার করার জন্য সার্কিট কোট্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রধান ফৌজদারী আদালত হিসাবে নিজামত আদালতকে (ঘরুধসধঃ অফধষধঃ) নাজিমের (ঘধুরস) স্থলাভিষিক্ত করা হয় এবং বেশ কিছু থানা বা পুলিশ ষ্টেশন স্থাপন করা হয়। দেওয়ানী আইন প্রশাসনের তুলনায় ফৌজদারী আইন প্রশাসনে অনেক বেশি পরিবর্তন আনা হয়েছিল। পূর্বের ন্যায় দেওয়ানী আইন প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন জজ এবং বেসামরিক বিচার প্রশাসনের জন্য এ সময়েই সর্ব প্রথম মুনসেফ নিয়োগ করা হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমলের বিচার প্রশাসন:- জজ হিসাবে হেংকেল সাহেব (১৭৮১-১৭৮৯) দেওয়ানী মামলা দেখাশোনা করতেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে তিনি শুধু জেলার পুলিশ বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর ¯^vaxb বিচার ক্ষমতা ছিল না। তাঁর অধঃস্তন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিকট থেকে মামলা গ্রহন করার মধ্যেই তাঁর ক্ষমতা সীমিত ছিল এবং যদি প্রয়োজনীয় মনে করতেন মামলাগুলো বিচারের জন্য দারোগার নিকট পাঠাতেন। উল্লেখ, দারোগা ছিলেন নাজিম-এর সরাসরি অধঃস্তন একজন কর্মকর্তা। ১৭৮৫সালে সরকার কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেটগনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এর ফলে ম্যাজিস্ট্রেটগণ ছোট খাট নির্যাতন, অভ্যাঘাত ও ছিচকে চোরির জন্য দায়েরকৃত মামলার শুনানী গ্রহন করে অপরাধীকে অনুর্দ্ধ ৪ দিনের কারাবাস অথবা ১৫ বার বেত্রাঘাতের দন্ডাদেশ প্রদানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। লর্ড কর্নওয়ালিসের সংস্কার চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দারোগার অধিকরের উপর এর বেশি হস্তক্ষেপ করা হত না। দারোগা ফৌজদারী আইন অনুসারে বিভিন্ন অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড, বেত্রাঘাত বা অংগ কাটা ইত্যাদি শাস্তি দিতে পারতেন। অপরাধী সাব্যস্ত হলে আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করতে হতো এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারাবাসের মেয়াদকাল উল্লেখ করা হতো না। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৭৯২সালে কারাগারের দায়িত্ব গ্রহনের সময় যশোর কারাগারে ৩০০জন কায়েদীর মধ্যে ১০৮জনই অনির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি ভোগ করছিল।১
১৯৮৪-পূর্বজেলা প্রশাসনঃ ডেপুটি কমিশনার:- ১৯৮৩সাল পর্যন্ত বৃহত্তর যশোর জেলা প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি)। জেলায় প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন ডেপুটি কমিশনার, তাই তিনি জেলা প্রশাসক নামেও খ্যাত। ডেপুটি কমিশনারের পদবী ১৯৬০সাল পর্যন্ত ছিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর (ডি এম)। তিনি ছিলেন মন্ত্রীপরিশোধ মন্ত্রনালয়ের সংস্থাপন বিভাগের অধীনস্থ জেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। তিনি একাধারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ভূমি ivR‡¯^i কালেক্টর ছিলেন। জেলার আইন-শৃৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব তাঁর উপরই ন্যস্ত ছিলেন। তিনি জাতি গঠন মূলক সব কর্মকান্ডের mgš^q করতেন। দুজন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার ডেপুটি কমিশনারকে সহায়তা করার জন্য নিয়োজিত ছিলেন। তাদের একজন সাধারণ প্রশাসন এবং অন্যজন রাজস্ব প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়াও বিচার সংক্রান্ত ব্যপারে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (সাধারণ) অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ডেপুটি কমিশনারকে সহায়তা দান করতেন। তদুপরি জেলার প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনারকে সহায়তা দানের জন্য নিয়োজিত ছিলেন বেশ কিছু ম্যাজিস্ট্রেট।
সাব-ডিভিশনাল অফিসার:- ১৯৮৩সাল পর্যন্ত বৃহত্তর যশোর জেলা চারটি মহকুমায় বিভক্ত ছিলঃ যশোর সদর, ঝিনাইদহ , মাগুরা এবং নড়াইল। প্রতি মহকুমার জন্য ছিলেন একজন সাব-ডিভিশনাল বা মহকুমার অফিসার। আইন-শৃংখলা রক্ষার প্রয়োজনে প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন বলে মহকুমা পর্যায়ে তিনিই ছিলেন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট। রাজস্ব প্রশাসনসহ প্রতিটি মহকুমার সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড তদারকীর দায়িত্ব মহকুমা অফিসারের উপর ন্যস্ত ছিল।
সার্কেল অফিসার:- বৃহত্তর যশোর-এর সবক’টি মহকুমায় সর্বমোট ২১টি থানা ছিল। সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) ছিলেন থানা পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প এবং অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখাশোনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একামাত্র সরকারী কর্মকর্তা। প্রতিটি থানা কতকগুলো ইউনিয়নে বিভক্ত ছিল। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ ছিল বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর। এলাকার জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান, দফাদার ও চৌকিদারদের সাহায্যে আধাসরকারী প্রশাসন পরিচালনা করতেন। ১৯৬১সালের পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের আওতায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুসলিম বিবাহ নিবন্ধক নিয়োগ করতেন এবং দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি প্রদানের ক্ষমতাও তাঁর ছিল।
মহকুমা বিলুপ্তি/নতুন জেলা:- সমপ্রতি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৮৪সালে মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নিত করা হয়। এর ফলে ২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ তারিখে ঝিনাইদহ মহকুমা এবং ১লা মার্চ ১৯৮৪ তারিখে যশোর সদর, নড়াইল ও মাগুরা মহকুমা এক একটি পূর্ণাংগ জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে বৃহত্তর যশোর বর্তমানে যশোর, ঝিনাইদহ মাগুরা, ও নড়াইল -এই চারটি আলাদা জেলায় পরিণত হয়েছে।১ শ্রেণীবিন্যাসের নীতি অনুযায়ী যশোর প্রথম শ্রেণীর জেলা, ঝিনাইদহ দ্বিতীয় শ্রেণীর জেলা এবং মাগুরা ও নড়াইল জেলাদ্বয় তৃতীয় শ্রেণীর জেলা অন্তর্গত।২ যশোর অঞ্চলের নবগঠিত জেলা গুলোর প্রশাসন পরিচালনার জন্য প্রণীত ও অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো ছক-ক, খ ও গ-এ দেখানো হয়েছে।
বর্তমান জেলা প্রশাসন:- পূর্বের ন্যায় বর্তমানেও জেলার প্রশাসনিক প্রধান হলেন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) বা জেলা প্রশাসক। সমগ্র জেলার সাধারণ প্রশাসন, রাজস্ব প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য ব্যক্তি বিধায় ডেপুটি কমিশনার কে প্রধান তত্বাবধায়ক ও mgš^qK হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। ডেপুটি কমিশনারের কাজে সহায়তা করার জন্য প্রতি জেলায় ২জন অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) ও ১জন করে অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) রয়েছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদ্বয়ের একজন সাধারণ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কর্মকান্ড এবং অন্যজন রাজস্ব বিষয়াদি দেখাশোনা করেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিচার সম্পর্কিত কাজ করে থাকেন। অবশ্য তৃতীয় শ্রেণীভূক্ত জেলা হওয়ার কারণে যশোর অঞ্চলের মাগুরা ও নড়াইল এদুটি জেলায় যে কোন একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (পদাধিকার বলে) দায়িত্ব পালন করেন। জেলা প্রশাসনের আওতাভুক্ত ডেপুটি কমিশনারের সাহায্য কারী অন্যান্যদের মধ্যে প্রতি জেলায় ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োজিত আছেন ১জন সহকারী পরিচালক স্থানীয় সরকার (এডিএলজি), ১জন নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (্এনডিসি), ১জন রেভেনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি), ১জন জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার (জিসিও), ১জন ভূমি হুকুম দখল অফিসার (এল এ ও), ১জন ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেট (টি এম), ১জন ত্রান ও পুনর্বাসন অফিসার (ডি আর আরও), ১জন সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ও ১জন হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা। এছাড়াও যশোর অঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর জেলা হিসাবে যশোরের জন্য ৯জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর জেলা হিসাবে ঝিনাইদহের জন্য ৪জন এবং তৃতীয় শ্রেণীর জেলা হিসাবে মাগুরা ও নড়াইলের জন্য ৩জন করে সহকারী কমিশনার রয়েছেন।
১৯৮০সাল পর্যন্ত ৪টি মহকুমা অধীনে বৃহত্তর যশোর জেলায় সর্বমোট ২০টি থানা ছিল। পরবর্তী বছর যশোর সদর মহকুমায় একটি থানা সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে বৃহত্তর যশোর জেলায় পূর্বের ২০টির স্থলে বর্তমানে ২১টি থানা হয়ে যায়। ১৯৮২সালে গৃহীত সরকারের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে মহকুমা গুলিকে যখন জেলায় উন্নিত করা হয় তখন থানা গুলিকেও পর্যায়ক্রমে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে পূর্বের মহকুমাগুলির ন্যায় উপজেলাগুলি সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রশাসনিক ইউনিট হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে। প্রতিটি উপজেলায় ‘উপজেলা পরিষদ’ সৃষ্টি করা হয়। জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যানগণ উপজেলার প্রধান হতেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবীধারী ১জন প্রথম শ্রেণীর ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে সহায়তা করতেন। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন প্রধান সরকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আইন-শৃংখলা রক্ষার্থে ফৌজদারী দন্ডবিধি প্রয়োগ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁকে কাজে সাহায্য করার জন্য ছিলেন একজন উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন সহকারী কমিশনার। একজন সহকারী জজ (১৯৮২-এর পূর্বে পদবী ছিল ‘মুন্সেফ’) দেওয়ানী মামলার বিচার সম্পন্ন করতেন। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে নিজস্ব কর্মকর্তা দ্বারা প্রতিটি মন্ত্রনালয় বা বিভাগের অফিস পরিচালিত হত।
১৯৯৩সালে সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপজেলা পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং প্রশাসনিক ইউনিট হিসাবে উপজেলা কে পুনরায় ‘থানা’ নামকরণ করা হয়। ফলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হলেন থানা নির্বাহী অফিসার এবং থানা পর্যায়ে তিনিই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা।
বৃহত্তর যশোর জেলায় বর্তমানে সর্বমোট ২১টি থানা রয়েছে (বৃহত্তর যশোর জেলার থানাসমূহের আয়তন ও জনসংখ্যা শীর্ষক তালিকা দ্রষ্টব্য)। প্রতিটি থানায় কয়েকটি করে ইউনিয়ন আছে। আবার একাধিক ওয়ার্ড নিয়ে ইউনিয়ন গঠিত। প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ বলতে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত কিছু ব্যক্তি বর্গের সমষ্টিকে বুঝায়। এই পরিষদে রয়েছে একজন চেয়ারম্যান ও কয়েকজন সদস্য বা ওয়ার্ড প্রতিনিধি (প্রতি ওয়ার্ড থেকে দু’জন)। চেয়ারম্যান গোটা ইউনিয়নের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। প্রতি ওয়ার্ডের জনগণ দু’জন প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। প্রত্যক্ষ ভোটে এবং তারাই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর এবং সাধারণ প্রশাসন ব্যবস্থার নিম্নতম স্তর।
ইংরেজ আমলের পুলিশ প্রশাসন:- যশোর জেলায় প্রথম ও ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ টিলম্যান হেংকেল (১৭৮১-১৭৮৯) পুলিশ শাসন ব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে ফৌজদারগণের ক্ষমতা খর্ব করে। উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার অবস্থান আনাহয় এবং তাঁদের অদীনস্থ অপেক্ষাকৃত ছোট এলাকার জন্য থানাদার নিয়োগ করা হয়। সেসময় ভূষণা, মীর্জানগর, ধর্মপুর, এবং নয়াবাদ (বর্তমান খুলনা) এই ৪টি থানা যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল। এই থানাগুলোর অধীনে ছিল কয়েকটি চৌকি বা আউট-পোষ্ট (ফাঁড়ি)। থানা পর্যায়ের পুলিশ অফিসারগণ ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী কিন্তু চৌকির দায়িত্বে নিয়োজিত গোয়েন্দা বা ‘ইনফরমার’-কে কোন বেতন দেওয়া হতোনা। তারা নিরীহ লোকজনদের নিকট হতে ভয় দেখিয়ে টাকা/ক্রোক আদায় করে জীবিকা নির্বাহ করত। ফৌজদারগণ সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতেন, অন্যদিকে তাঁর অধঃস্তন কর্মচারীগণ গোপনে অপরাধীদের সাহায্য সহযোগিতা প্রদানে লিপ্ত ছিল। মিঃ হেংকেল যখন যশোর জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত হলেন সে সময়ে ৫০ শক্তিশালী ডাকাত দল এই অঞ্চলে ঘুরে ডাকাত দল এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। তাঁর নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ফেীজদার প্রথা বিলুপ্ত পয়ে যায় এবং ফৌজদারদের সমস্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব মিঃ হেংকেল-এর ওপর অর্পিত হয়। মিঃ হেংকেল এর প্রস্তাব অনুযায়ী এই অঞ্চলের ৪টি থানা প্রত্যেকটির জন্য ১জন করে গির্দাওয়ার বা হেড পুলিশ অফিসার বসানো হয়। হেড পুলিশ অফিসারের প্রধান দায়িত্ব ছিল ডাকাত আটক করে বিচারের জন্য যশোর জেলার প্রথম সদর দপ্তর ‘মুড়লী’তে প্রেরণ করা। থানার অধীনস্থ চৌকিসমূহের অবৈতনিক ইনফরমা-এর পরিবর্তে বিদেশী সেপাহী নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয় যেহেতু দেশীয় বরকন্দাজণ অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজসে সিদ্ধাহস্ত ছিল। পুলিশকে সামরিকীকরণের উদ্দেশ্য ছিল শুধু ছোটখাট অপরাধ কর্ম মোকাবেলা করা নয় বরং ডাকাতি ও খুনের মত বড় অপরাধসমূহ সংঘটিত হতে বাধাদান করা।১
এই পুলিশ ব্যবস্থা ছিল বেশ ব্যয়বহুল। এর জন্য প্রতি মাসে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা খরচ হত। তাই ১৭৮২ সালে সরকার কর্তৃক মুড়লীর বাইরের অন্যান্য পুলিশ সংস্থাপন বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ জারি করা হয়। পুলিশের দায়িত্ব জমিদারদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। নিজ নিজ এলাকায় যাতে ডাকাতি, রাহাজানি ও খুন সংঘটিত না হয় সেজন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার নিমিত্ত জমিদারদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সকল অপরাধীকে বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনার সকল তৎপরতা চালানোর জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট পরামর্শ অনুযায়ী জমিদারগনকে যেখানে প্রয়োজন থানা প্রতিষ্ঠা করে অফিসার নিয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হতো। জমিদারকে নিজ এলাকায় সংঘটিত ডাকাতির কারণে ক্ষতিগ্রস্থদের আর্থিক সাহায্য দিতে হতো। কোন জমিদার নিজ এলাকার সংঘটিত খুন রাহাজানি বা শান্তি ভঙ্গের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে বলে প্রমাণিত হলে সেই জমিদারকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত ভোগ করতে হতো। জমিদার শাসিত পুলিশ ব্যবস্থা ১৭৮২ থেকে ১৭৯২সালে লর্ড কর্ণওয়ালিসের প্রশাসনিক সংস্কার কার্যকর করা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। অর্থাৎ উক্ত সময়কাল সমাজে শান্তি শৃংখলা-রক্ষায় দায়িত্ব জমিদারগণকেই পালন করতে হতো।
বর্তমান যশোর অঞ্চলের প্রথক কিন্তু তথ্যবহুল প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কিত সঠিক দলিল এযাবৎ পাওয়া যায়নি। পুরাতন গল্পকাহিনী ও কিংবদন্তি-নির্ভর ইতিহাস থেকে ধারণা লাভ করা যায় যে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত যশোর অঞ্চল গুপ্ত বংশীয় রাজাদের শাসনাধীন ছিল। গুপ্ত শাসনের অবসানের পর বাংলার অংশ হিসাবে যশোর অঞ্চল ৫৭৫সাল পর্যন্ত ¯^vaxb ও শক্তিশালা রাজাদের অধীনে ছিল। এরপর যশোর ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত শশাংক, হর্ষবর্ধন ও অন্যান্য রাজাদের অধিকারে ছিল।
মুসলমানদের শাসনাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় পাঁচশ বছর পাল (৭৮১-১০৮০), বর্মন (১০৮০-১১৫০)সাল এবং সেন (১১৫০-১৩০০) বংশীয় রাজাগল যশোর অঞ্চল শাসন করেন।২
ত্রয়োদশ মতাব্দীর শেষের দিকে সুলতান মুঘিসুদ্দিন তগরাল-এর সময় (১২৬৮-১২৮১সাল) যশোর অঞ্চ মুসলমানদের শাসনাধীন হয়ে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এ সময়কাল সুলতানী আমল হিসাবে ইতিহাস খ্যাত।
সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা প্রশে মোঘল সাম্রাজের অধীনে চলে এলেও বাংলার বার ভূঁইয়ারদের অন্যতম জামিদার প্রতাপাদিত্য প্রদত্ত বিরোধিতার কারণে ১৬১২সাল পর্যন্ত যশোর মোঘল শাসনের অধীনে আসতে পারেনি। অর্থাৎ সম্রাট জাহাংগীরের আমলে বাংলার শক্তিধর গভর্ণর ইসলাম খান-এর সময় যশোর মোঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ব অধিক্ষেত্র : যশোর জেলা ১৭৬৫ সালের ১২ই আগস্ট মোঘল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় কর্তৃক প্রদত্ত দিওয়ানীর আওতায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনধীনে আসে।৫ ইউসুফপুর ও সৈয়দপুর পরগণাদ্বয়ের অন্তর্গত ১৩৬৫বর্গমাইল এলাকা সংলগ্ন যশোর (বর্তমান যশোর জেলার বেশিরভাগ অংশ), খুলনা (বর্তমান খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা) এবং ২৪ পরগনা (বর্তমান ভারতের পশ্চিম বংগের একটি অংশ) নামক অঞ্চলগুলো নিয়েই গঠিত হয়েছিল তখনকার যশোর জেলা। ১৭৯৩সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গঠিত হয়েছিল হওয়ার সময়ে যশোর জেলাকে পুনর্গঠিত করা হয়। এর ফলে যশোর সদর মহকুমা (বর্তমান যশোর জেলা), খুলনা সদর মহকুমা (বর্তমান খুলনা জেলা), ফরিদপুর (বর্তমান গোপালগঞ্জ ও রাজশাহী জেলা) এবং কুষ্টিয়া (বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা) অঞ্চল পুনর্গঠিত যশোর জেলায় চলে আসে।
বৃটিশ শাসন ও অধিক্ষেত্রের পরিবর্তন:- পৃথক জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর হতে বিভিন্ন সময়ে যশোর এর আয়তন ও সীমানায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৭৮৬সালে যখন জেলার জন্য একজন কালেক্টর নিয়োগ করা হয় তখন বিচার প্রশাসন পূর্বতন অর্থাৎ বৃহত্তর ফরিদপুর, বৃহত্তর যশোর এবং আছামতি নদীর পূর্বপার্শ্বস্থ ২৪-পরগণা জেলার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছিল। ১৭৯৩সালে ভূষণাকে যশোরের সংগে যুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে নোয়াপাড়া ও কুষ্টিয়া মূর্শিদাবাদ হতে আলাদা করে যশোরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৭৯৪সালে যাউদিয়া ও গজনবীপুর পরগণাদ্বয়কে যশোর থেকে আলাদা করে নদীয়ার সংগে জুড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ঝিকরগাছা হয়ে যায় যশোরের পশ্চিম দিকের সীমান্ত ১৭৯৯সালে নদীয়ার মির্জানগরকে যশোরের সংগে যুক্ত করা হয়। ১৮১২সালে চান্দা ও বলেশ্বর নদীকে পূর্ব-সীমানা হিসাবে নির্ধারণ করা হয় এবং টাকি থানাকে নদীয়ার সংগে দেওয়া হয়। সীমানা পরিবর্তনের সংগে সম্পর্কযুক্ত একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা ঘটে ১৮১৪সালে যখন যশোরকে ফরিদপুর থেকে পৃথক করা হয়। ১৯২৮সালে কয়েকটি থানা যেমন- ধর্মপুর (পাংশা), কুষ্টিয়া, মধুপুর এবং খোকশাকে পাবনার সংগে যুক্ত করা হয়।
নীল বিদ্রোহ দমনের কৌশল হিসাবে ১৮৬০-৬১সালে যশোর জেলাকে কয়েকটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়। মহকুমা গুলো হলঃ খুলনা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল ও যশোর। ১৮৬১সালে কচুয়া থানাকে বাকেরগঞ্জ থেকে আলাদা করে যশোর-এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৮২সালে খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমাকে যশোর থেকে পৃথক করা হয়। ১৮৮৩সালে বনগাঁ মহকুমাকে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিম বংগের নদীয়া জেলার অন্তর্গত) যশোর-এর সংগে যুক্ত করা হয়। বৃটিশ সরকার প্রত্যক্ষ শাসন-ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ১৭৮১সালে একটি আদালত স্থাপনের মাধ্যমে মুড়লীকেই যশোরের সদর দপ্তর করা হয়েছিল। ১৭৯০সালে যশোর-এর সদর দপ্তর মড়লী থেকে দু-মাইল উত্তরে বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসনের শুরু :- যশোর অঞ্চল ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত ইঙগ-মোঘল যৌথ শাসনাধীন ছিল। ওয়ারেন হ্যাস্টিংস ১৭৭২সালে বাংলার গভর্নর হওয়ার পর ¯^í সময়ের জন্য একজন ইউরোপীয়কে যশোর-এর কালেক্টর হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন।১ তাঁর কার্যকাল ১৭৭২ থেকে ১৭৭৪ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দেওয়ানী আদালতের বিচারকের ক্ষমতাসম্পন্ন এই কালেক্টরের কার্যালয়টি ১৭৭৪সালে বিলুপ্ত করা হয়। একই ব্যক্তিকে একাধারে জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৭৮১সালের মে মাসে টিলম্যাণ হেংকেল যশোরের একটি কালেক্টরেট স্থাপিত হয়েছিল এবং হেংকেল কালেক্টর হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইতোপূর্বে জেলার পূবাঞ্চল ব্যতীত যশোরের অন্যান্য এলাকার রাজস্ব প্রশাসনের সদর দপ্তর ছিল কলকাতা। হেংকেল সাহেব রাজস্ব প্রশাসনের কিছু অসুবিধা দুর করার নিমিত্ত বিনা অতিরিক্ত বেতনে কালেক্টরের দায়িত্ব পালন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠালেন। সরকার কর্তৃক তার প্রস্তাব তাৎক্ষনিকভাবে গৃহীত হয় এবং যশোরের জন্য একটি কালেক্টরেট সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে ইছামতী নদী ও বাকেরগঞ্জ জেলার (পূর্বে যা ঢাকার অংশ ছিল) মধ্যবর্তী ইউসুফপুর এবং সায়েদপুর জমিদারীদ্বয়, যে এলাকাগুলোর রাজস্ব আদায়ের সদর দপ্তর ছিল যথাক্রমে কলকাতা ও হুগলী, যশোর কালেক্টরেটের অধীনে চলে আসে।২
ভূমি রাজস্ব পরিশোধ নিশ্চিত করার নিমিত্ত কালেক্টর ক্রমাগত খেলাপী রাজস্ব দাতাদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করতেন। খেলাপীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। আইনানুগ শাস্তি হিসাবে ‘খেলাপীদের-জেল’-এ অন্তরীণ রাখার ব্যবস্থাও ছিল। কলেক্টর একদিকে যেমন যে কোন জমির খাজনা সরাসরি গ্রহন করতেন, অন্যদিকে যে কোন সম্পত্তির উপর নতুন খাজনা আরোপ করতে পারতেন। জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে ১৭৯৩ কালেক্টরের কার্যালয়টিকে পৃথক করা পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে উপরোক্ত পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।
লর্ড কর্ণওয়ালিশ আনীত সংস্কার গুলো ব্রিটিশ প্রশাসনকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিল। তাঁর আমলেই দারোগার পদটি বিলুপ্ত করে ম্যাজিস্ট্রেটকে ছোটখাট যাবতীয় ফৌজদারী মামলা বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ঘৃন্য অপরাধীদের বিচার করার জন্য সার্কিট কোট্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রধান ফৌজদারী আদালত হিসাবে নিজামত আদালতকে (ঘরুধসধঃ অফধষধঃ) নাজিমের (ঘধুরস) স্থলাভিষিক্ত করা হয় এবং বেশ কিছু থানা বা পুলিশ ষ্টেশন স্থাপন করা হয়। দেওয়ানী আইন প্রশাসনের তুলনায় ফৌজদারী আইন প্রশাসনে অনেক বেশি পরিবর্তন আনা হয়েছিল। পূর্বের ন্যায় দেওয়ানী আইন প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন জজ এবং বেসামরিক বিচার প্রশাসনের জন্য এ সময়েই সর্ব প্রথম মুনসেফ নিয়োগ করা হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমলের বিচার প্রশাসন:- জজ হিসাবে হেংকেল সাহেব (১৭৮১-১৭৮৯) দেওয়ানী মামলা দেখাশোনা করতেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে তিনি শুধু জেলার পুলিশ বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর ¯^vaxb বিচার ক্ষমতা ছিল না। তাঁর অধঃস্তন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিকট থেকে মামলা গ্রহন করার মধ্যেই তাঁর ক্ষমতা সীমিত ছিল এবং যদি প্রয়োজনীয় মনে করতেন মামলাগুলো বিচারের জন্য দারোগার নিকট পাঠাতেন। উল্লেখ, দারোগা ছিলেন নাজিম-এর সরাসরি অধঃস্তন একজন কর্মকর্তা। ১৭৮৫সালে সরকার কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেটগনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এর ফলে ম্যাজিস্ট্রেটগণ ছোট খাট নির্যাতন, অভ্যাঘাত ও ছিচকে চোরির জন্য দায়েরকৃত মামলার শুনানী গ্রহন করে অপরাধীকে অনুর্দ্ধ ৪ দিনের কারাবাস অথবা ১৫ বার বেত্রাঘাতের দন্ডাদেশ প্রদানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। লর্ড কর্নওয়ালিসের সংস্কার চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দারোগার অধিকরের উপর এর বেশি হস্তক্ষেপ করা হত না। দারোগা ফৌজদারী আইন অনুসারে বিভিন্ন অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড, বেত্রাঘাত বা অংগ কাটা ইত্যাদি শাস্তি দিতে পারতেন। অপরাধী সাব্যস্ত হলে আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করতে হতো এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারাবাসের মেয়াদকাল উল্লেখ করা হতো না। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৭৯২সালে কারাগারের দায়িত্ব গ্রহনের সময় যশোর কারাগারে ৩০০জন কায়েদীর মধ্যে ১০৮জনই অনির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি ভোগ করছিল।১
১৯৮৪-পূর্বজেলা প্রশাসনঃ ডেপুটি কমিশনার:- ১৯৮৩সাল পর্যন্ত বৃহত্তর যশোর জেলা প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি)। জেলায় প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন ডেপুটি কমিশনার, তাই তিনি জেলা প্রশাসক নামেও খ্যাত। ডেপুটি কমিশনারের পদবী ১৯৬০সাল পর্যন্ত ছিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর (ডি এম)। তিনি ছিলেন মন্ত্রীপরিশোধ মন্ত্রনালয়ের সংস্থাপন বিভাগের অধীনস্থ জেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। তিনি একাধারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ভূমি ivR‡¯^i কালেক্টর ছিলেন। জেলার আইন-শৃৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব তাঁর উপরই ন্যস্ত ছিলেন। তিনি জাতি গঠন মূলক সব কর্মকান্ডের mgš^q করতেন। দুজন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার ডেপুটি কমিশনারকে সহায়তা করার জন্য নিয়োজিত ছিলেন। তাদের একজন সাধারণ প্রশাসন এবং অন্যজন রাজস্ব প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়াও বিচার সংক্রান্ত ব্যপারে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (সাধারণ) অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ডেপুটি কমিশনারকে সহায়তা দান করতেন। তদুপরি জেলার প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনারকে সহায়তা দানের জন্য নিয়োজিত ছিলেন বেশ কিছু ম্যাজিস্ট্রেট।
সাব-ডিভিশনাল অফিসার:- ১৯৮৩সাল পর্যন্ত বৃহত্তর যশোর জেলা চারটি মহকুমায় বিভক্ত ছিলঃ যশোর সদর, ঝিনাইদহ , মাগুরা এবং নড়াইল। প্রতি মহকুমার জন্য ছিলেন একজন সাব-ডিভিশনাল বা মহকুমার অফিসার। আইন-শৃংখলা রক্ষার প্রয়োজনে প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন বলে মহকুমা পর্যায়ে তিনিই ছিলেন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট। রাজস্ব প্রশাসনসহ প্রতিটি মহকুমার সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড তদারকীর দায়িত্ব মহকুমা অফিসারের উপর ন্যস্ত ছিল।
সার্কেল অফিসার:- বৃহত্তর যশোর-এর সবক’টি মহকুমায় সর্বমোট ২১টি থানা ছিল। সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) ছিলেন থানা পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প এবং অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখাশোনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একামাত্র সরকারী কর্মকর্তা। প্রতিটি থানা কতকগুলো ইউনিয়নে বিভক্ত ছিল। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ ছিল বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর। এলাকার জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান, দফাদার ও চৌকিদারদের সাহায্যে আধাসরকারী প্রশাসন পরিচালনা করতেন। ১৯৬১সালের পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের আওতায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুসলিম বিবাহ নিবন্ধক নিয়োগ করতেন এবং দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি প্রদানের ক্ষমতাও তাঁর ছিল।
মহকুমা বিলুপ্তি/নতুন জেলা:- সমপ্রতি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৮৪সালে মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নিত করা হয়। এর ফলে ২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ তারিখে ঝিনাইদহ মহকুমা এবং ১লা মার্চ ১৯৮৪ তারিখে যশোর সদর, নড়াইল ও মাগুরা মহকুমা এক একটি পূর্ণাংগ জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে বৃহত্তর যশোর বর্তমানে যশোর, ঝিনাইদহ মাগুরা, ও নড়াইল -এই চারটি আলাদা জেলায় পরিণত হয়েছে।১ শ্রেণীবিন্যাসের নীতি অনুযায়ী যশোর প্রথম শ্রেণীর জেলা, ঝিনাইদহ দ্বিতীয় শ্রেণীর জেলা এবং মাগুরা ও নড়াইল জেলাদ্বয় তৃতীয় শ্রেণীর জেলা অন্তর্গত।২ যশোর অঞ্চলের নবগঠিত জেলা গুলোর প্রশাসন পরিচালনার জন্য প্রণীত ও অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো ছক-ক, খ ও গ-এ দেখানো হয়েছে।
বর্তমান জেলা প্রশাসন:- পূর্বের ন্যায় বর্তমানেও জেলার প্রশাসনিক প্রধান হলেন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) বা জেলা প্রশাসক। সমগ্র জেলার সাধারণ প্রশাসন, রাজস্ব প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য ব্যক্তি বিধায় ডেপুটি কমিশনার কে প্রধান তত্বাবধায়ক ও mgš^qK হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। ডেপুটি কমিশনারের কাজে সহায়তা করার জন্য প্রতি জেলায় ২জন অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) ও ১জন করে অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) রয়েছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদ্বয়ের একজন সাধারণ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কর্মকান্ড এবং অন্যজন রাজস্ব বিষয়াদি দেখাশোনা করেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিচার সম্পর্কিত কাজ করে থাকেন। অবশ্য তৃতীয় শ্রেণীভূক্ত জেলা হওয়ার কারণে যশোর অঞ্চলের মাগুরা ও নড়াইল এদুটি জেলায় যে কোন একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (পদাধিকার বলে) দায়িত্ব পালন করেন। জেলা প্রশাসনের আওতাভুক্ত ডেপুটি কমিশনারের সাহায্য কারী অন্যান্যদের মধ্যে প্রতি জেলায় ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োজিত আছেন ১জন সহকারী পরিচালক স্থানীয় সরকার (এডিএলজি), ১জন নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (্এনডিসি), ১জন রেভেনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি), ১জন জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার (জিসিও), ১জন ভূমি হুকুম দখল অফিসার (এল এ ও), ১জন ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেট (টি এম), ১জন ত্রান ও পুনর্বাসন অফিসার (ডি আর আরও), ১জন সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ও ১জন হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা। এছাড়াও যশোর অঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর জেলা হিসাবে যশোরের জন্য ৯জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর জেলা হিসাবে ঝিনাইদহের জন্য ৪জন এবং তৃতীয় শ্রেণীর জেলা হিসাবে মাগুরা ও নড়াইলের জন্য ৩জন করে সহকারী কমিশনার রয়েছেন।
১৯৮০সাল পর্যন্ত ৪টি মহকুমা অধীনে বৃহত্তর যশোর জেলায় সর্বমোট ২০টি থানা ছিল। পরবর্তী বছর যশোর সদর মহকুমায় একটি থানা সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে বৃহত্তর যশোর জেলায় পূর্বের ২০টির স্থলে বর্তমানে ২১টি থানা হয়ে যায়। ১৯৮২সালে গৃহীত সরকারের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে মহকুমা গুলিকে যখন জেলায় উন্নিত করা হয় তখন থানা গুলিকেও পর্যায়ক্রমে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে পূর্বের মহকুমাগুলির ন্যায় উপজেলাগুলি সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রশাসনিক ইউনিট হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে। প্রতিটি উপজেলায় ‘উপজেলা পরিষদ’ সৃষ্টি করা হয়। জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যানগণ উপজেলার প্রধান হতেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবীধারী ১জন প্রথম শ্রেণীর ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে সহায়তা করতেন। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন প্রধান সরকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আইন-শৃংখলা রক্ষার্থে ফৌজদারী দন্ডবিধি প্রয়োগ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁকে কাজে সাহায্য করার জন্য ছিলেন একজন উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন সহকারী কমিশনার। একজন সহকারী জজ (১৯৮২-এর পূর্বে পদবী ছিল ‘মুন্সেফ’) দেওয়ানী মামলার বিচার সম্পন্ন করতেন। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে নিজস্ব কর্মকর্তা দ্বারা প্রতিটি মন্ত্রনালয় বা বিভাগের অফিস পরিচালিত হত।
১৯৯৩সালে সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপজেলা পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং প্রশাসনিক ইউনিট হিসাবে উপজেলা কে পুনরায় ‘থানা’ নামকরণ করা হয়। ফলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হলেন থানা নির্বাহী অফিসার এবং থানা পর্যায়ে তিনিই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা।
বৃহত্তর যশোর জেলায় বর্তমানে সর্বমোট ২১টি থানা রয়েছে (বৃহত্তর যশোর জেলার থানাসমূহের আয়তন ও জনসংখ্যা শীর্ষক তালিকা দ্রষ্টব্য)। প্রতিটি থানায় কয়েকটি করে ইউনিয়ন আছে। আবার একাধিক ওয়ার্ড নিয়ে ইউনিয়ন গঠিত। প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ বলতে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত কিছু ব্যক্তি বর্গের সমষ্টিকে বুঝায়। এই পরিষদে রয়েছে একজন চেয়ারম্যান ও কয়েকজন সদস্য বা ওয়ার্ড প্রতিনিধি (প্রতি ওয়ার্ড থেকে দু’জন)। চেয়ারম্যান গোটা ইউনিয়নের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। প্রতি ওয়ার্ডের জনগণ দু’জন প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। প্রত্যক্ষ ভোটে এবং তারাই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর এবং সাধারণ প্রশাসন ব্যবস্থার নিম্নতম স্তর।
ইংরেজ আমলের পুলিশ প্রশাসন:- যশোর জেলায় প্রথম ও ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ টিলম্যান হেংকেল (১৭৮১-১৭৮৯) পুলিশ শাসন ব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে ফৌজদারগণের ক্ষমতা খর্ব করে। উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার অবস্থান আনাহয় এবং তাঁদের অদীনস্থ অপেক্ষাকৃত ছোট এলাকার জন্য থানাদার নিয়োগ করা হয়। সেসময় ভূষণা, মীর্জানগর, ধর্মপুর, এবং নয়াবাদ (বর্তমান খুলনা) এই ৪টি থানা যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল। এই থানাগুলোর অধীনে ছিল কয়েকটি চৌকি বা আউট-পোষ্ট (ফাঁড়ি)। থানা পর্যায়ের পুলিশ অফিসারগণ ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী কিন্তু চৌকির দায়িত্বে নিয়োজিত গোয়েন্দা বা ‘ইনফরমার’-কে কোন বেতন দেওয়া হতোনা। তারা নিরীহ লোকজনদের নিকট হতে ভয় দেখিয়ে টাকা/ক্রোক আদায় করে জীবিকা নির্বাহ করত। ফৌজদারগণ সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতেন, অন্যদিকে তাঁর অধঃস্তন কর্মচারীগণ গোপনে অপরাধীদের সাহায্য সহযোগিতা প্রদানে লিপ্ত ছিল। মিঃ হেংকেল যখন যশোর জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত হলেন সে সময়ে ৫০ শক্তিশালী ডাকাত দল এই অঞ্চলে ঘুরে ডাকাত দল এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। তাঁর নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ফেীজদার প্রথা বিলুপ্ত পয়ে যায় এবং ফৌজদারদের সমস্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব মিঃ হেংকেল-এর ওপর অর্পিত হয়। মিঃ হেংকেল এর প্রস্তাব অনুযায়ী এই অঞ্চলের ৪টি থানা প্রত্যেকটির জন্য ১জন করে গির্দাওয়ার বা হেড পুলিশ অফিসার বসানো হয়। হেড পুলিশ অফিসারের প্রধান দায়িত্ব ছিল ডাকাত আটক করে বিচারের জন্য যশোর জেলার প্রথম সদর দপ্তর ‘মুড়লী’তে প্রেরণ করা। থানার অধীনস্থ চৌকিসমূহের অবৈতনিক ইনফরমা-এর পরিবর্তে বিদেশী সেপাহী নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয় যেহেতু দেশীয় বরকন্দাজণ অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজসে সিদ্ধাহস্ত ছিল। পুলিশকে সামরিকীকরণের উদ্দেশ্য ছিল শুধু ছোটখাট অপরাধ কর্ম মোকাবেলা করা নয় বরং ডাকাতি ও খুনের মত বড় অপরাধসমূহ সংঘটিত হতে বাধাদান করা।১
এই পুলিশ ব্যবস্থা ছিল বেশ ব্যয়বহুল। এর জন্য প্রতি মাসে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা খরচ হত। তাই ১৭৮২ সালে সরকার কর্তৃক মুড়লীর বাইরের অন্যান্য পুলিশ সংস্থাপন বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ জারি করা হয়। পুলিশের দায়িত্ব জমিদারদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। নিজ নিজ এলাকায় যাতে ডাকাতি, রাহাজানি ও খুন সংঘটিত না হয় সেজন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার নিমিত্ত জমিদারদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সকল অপরাধীকে বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনার সকল তৎপরতা চালানোর জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট পরামর্শ অনুযায়ী জমিদারগনকে যেখানে প্রয়োজন থানা প্রতিষ্ঠা করে অফিসার নিয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হতো। জমিদারকে নিজ এলাকায় সংঘটিত ডাকাতির কারণে ক্ষতিগ্রস্থদের আর্থিক সাহায্য দিতে হতো। কোন জমিদার নিজ এলাকার সংঘটিত খুন রাহাজানি বা শান্তি ভঙ্গের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে বলে প্রমাণিত হলে সেই জমিদারকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত ভোগ করতে হতো। জমিদার শাসিত পুলিশ ব্যবস্থা ১৭৮২ থেকে ১৭৯২সালে লর্ড কর্ণওয়ালিসের প্রশাসনিক সংস্কার কার্যকর করা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। অর্থাৎ উক্ত সময়কাল সমাজে শান্তি শৃংখলা-রক্ষায় দায়িত্ব জমিদারগণকেই পালন করতে হতো।