
Home ঐতিহ্য (Tradition) > শতবর্ষে রামনারায়ন পাবলিক লাইব্রেরী (আমরিুল আলম খান) - আপডেট চলছে
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86813 বার পড়া হয়েছে
শতবর্ষে রামনারায়ন পাবলিক লাইব্রেরী (আমরিুল আলম খান) - আপডেট চলছে
প্রথমে দারুন প্রতিযোগিতা, পরে বৈবাহিক স্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিযোগী দুই পরিবারের সহযোগিতার মধুর পরিণতি লোহাগড়া রামনারায়ন পাবলিক লাইব্রেরি। প্রতিষ্ঠা শতবর্ষ পূর্বে, ১৯০৭ সালে। শতর্ব বয়সী গ্রন্থাগারটির ইতিহাসে আছে উত্থান, আছে স্থবিরতা, চক্রান্তের গ্লানি ও রাহুমক্তির অনাবিল আনন্দ।
তিনটি থানা নিয়ে এখনকার নড়াইল জেলা। তিনটি থানাই নানা কারণে বিখ্যাত। এর মধ্যে কালিয়ার খ্যাতি সবার ্ওপরে ও বিশ্বব্যাপী। নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর ও সেতারশিল্পী রবিশঙ্করের জন্মদাত্রী কালিয়া। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যখন ¯^‡`wk আন্দোলনে ব্যস্ত তখন কালিয়ার শুধু একটি পরিবারেই ২০০ গ্রাজুয়েট, ২৭জন আই সি এস! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। নড়াইলের সন্তান সুলতান বিশ্বনন্দিত চিত্র শল্পিী। ১৮৩৬ সালে যশোর জিলা স্কুলের প্রতিষ্ঠা হলেও প্রথম কলেজটি যশোরে নয়। প্রতিষ্ঠিত হয় নড়াইলে। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরিয়া কলেজের সঙ্গে একটি কলেজিয়েট স্কুলও। রাজনীতিতেও নড়াইলের গৗরবসূর্যের আলোকে দীপ্ত যশোর ভূমি। নড়াইলের তেভাগা আন্দোলণ ইতিহাসের পাতায় ¯^Y©v‡i লিখিত।
বিশ শতকের প্রারম্ভে নড়াইল আদতেই ছিল গ্রাম। সে সময় লোহাগড়ায় ছিল প্রতাপশালী তনি জমিদার পরিবার রায়, মজুমদার ও সরকার। তিনটি পরিবারই অব্রাক্ষণ। সুতরাং ব্রাক্ষণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হয়েছিল বিত্য ও বিদ্যার দোধারী তরবারি দিয়েই।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে জমিদারির বিপুল বৈভব রামপ্রসাদ রায়ের। তারা মনে করতেন চিত্ত বিকাশের জন্য প্রয়োজন বিত্তের বিকাশ। তাই তারা সচেষ্ট হন ব্যবসা বানিজ্যের প্রসারে। বররুজীবী মজুমদার পরিবারের হাতেও বিপুল অর্থ। মজুমদার পরিবারের বহুভাষাবদি আইনজীবী যদুনাথ মজুমদার বিখ্যাত লাহোর ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক। নীল বিদ্রোহে অভিযুক্ত কৃষকদের পক্ষে তিনি বিনা পয়সায় ামলা লড়ে তাদের রক্ষা করেন এবং যশোর অঞ্চলে নীল চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে সমর্থ হন। তিনি যশোর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান। যশোর পৌরসভারও চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘকাল। জাতীয় কংগ্রেসের এই নেতা ছিলেন আপাদমস্তম অসামপ্রদায়িক, নিরহংকারী এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। যশোর টাউন হল নিউ আর্য থিয়েটার। যশোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তার। যদুনাথ মজুমদার একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন লোহাগড়ায় নিজ বাড়ীতে। সরকার পরিবারের মেধাবী ছাত্র মহেন্দ্রনাথ সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে বিএইচডি। সৌম দর্শন, সুলেখক ও অসাধারণ বাগ্মী হেন্দ্রনাথ অধ্যাপনা করতেন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে। মজুমদার পরিবারের মতো সরকার পরিবারও একটি গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে দিলেন জ্ঞান সাধনায় তারাও কম নন। এই প্রতিযোগিতার মধুর সমাপ্তি ঘটে যদুনাথ মজুমদারের বিদুষী কন্যা লীলাবতীর সঙ্গে ড. মহেন্দ্রনাথের শুভ পরিনয়ে। তা পারিবারিক প্রতিযোগিতা যখন আত্মীয়তায় রূপ নিল তখন দুটো গণ পাঠাগার একদেহে লীন হতে বাধা কোথায়? মজুমদার ও সরকার পরিবারের দুই গণপাঠাগার একীভূত করে মহেন্দ্রনাথ রাম রাখেন শ্রীকৃষ্ণ লাইব্রেরী। ১৯০৭ সালে ভুবনমোহন সরকার ¯^Mx©q পিতার নামে নতুন নাম করণ করেন রাম নারায়ন পাবলিক লাইব্রেরি’ এবং নির্মাণ করেন একটি দোতালা ববন। এই পরিবারের খ্যাতিমান আইনজীবী অবিনাশ চন্দ্র সরকার ১৯৩২ সালে যশোর পাবলিক লাইব্রেরির জন্য নির্মাণ করেন বিশ্বনাথ হল।
১৯১৮ সালে রাম নারায়ন পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থসংখ্যা ছিল এক হাজার। সাতচল্লিশে দেশভাগরে সময় তা প্রায় তিন হাজার। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা নিয়মিত আসত। যশোর জেলা বোর্ড বার্ষিক অনুদান দিত ৩০টাকা। এ ছাড়া যদুনাথ সরকার ব্যক্তিগতভাবে বছরে ১০ টাকা দিতেন। যদুনাথ মজুমদারের সমুদয় সম্পত্তি শিক্ষা বিস্তারে উৎসর্গিত। সদস্যদের চাঁদার পরিবর্তে ধনীদের ব্যক্তিগত দানে নির্বাহ হতো লাইব্রেরির ব্যয়। লাইব্রেরির পাশাপাশি গড়ে তোলা হয় একটি জিমনেসিয়াম। ¯^‡`wk আন্দোলনে এখানে নানা প্রকার শারীরিক কসরত ও লাঠিখেলা শিক্ষা দেওয়া হতো।
যদুনাথ মজুমদারের মৃত্যু, দেশ বিভাগ, আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন, হিন্দুদের ব্যাপক সংখ্যায় দেশ ত্যাগ ইতাদি কারণে যশোর পাবলিক লাইব্রেরির মতোই লোহাগড়া রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরির ইতিহাসও মসিলিপ্ত। পরবর্তী ১০ বছর এই লাইব্রেরি দেখাশোনার কেউ ছিল না। ১৯৫৯ সালে শিক্ষানুরাগী সার্কেল অফিসার এম এ মজিদ তাতে প্রাণসঞ্চয়রে উদ্যোগ নেন। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর আবার সেই অন্ধকার। ১৯৬২ সালে লোহাগড়া সমবায় কলেজ পতিষ্ঠার জন্য লাইব্রেরি ভবন অধিগ্রহণ করা হলে লাইব্রেরিটি উদ্ধাস্ত হলে শুরু হয় তার অন্ধকার ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়।
১৯৬৪ সালৈ সেই অন্ধ কুঠরির জগদ্দল পাথর অপসারণে উদ্যোগী হন নড়াইল ভিক্টোরিয়অ কলেজের তরুন শিক্ষক মোহম্মাদ শরীফ হোসেন। তাঁকে সমর্থন দেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের গ্রন্থাগার উন্নয়নে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা আহম্মাদ হোসেন ও যশোরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট এম এ কাজিম। ১৯৬৫ সালে আনেয়ারুজ্জামান, সৈয়দ গোলাম ওমাস্তফা লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন ও অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে সয়ৈদ গোলাম মোস্তফা প্রণয়ণ করেন নতুন গঠনতন্ত্র। নির্বাচিত নতুন কার্যনির্বাহী পর্ষদ লাইব্রেরির উন্নয়নে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৬২ সালে রিকুইজিশন হয়ে যাওয়া লাইব্রেরি ভবন রিকুইজিশনমুক্ত করার চেষ্টা শুরু হতেই কোটারি ¯^v_©ev`xiv তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করে মিথ্যা মামলা। মহকুমা প্রশাসক আহম্মাদ হোসেনের মধ্যস্থতায় মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পান লাইব্রেরি প্রেমিকরা। এভাবে রাহুমুক্ত হয় জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরি।
অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন, আনেয়ারুজ্জামান, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, অলোকানন্দ দাশ, আবদুল মালেক, সরিাজুল হক, মুন্সি আতিয়ার রহমান, খন্দকার নজরুল ইসলাম প্রমুখ দুঃসময় এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন শক্ত হাতে। তাদের সাহস জুগিয়েছেন এবং সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়েছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফ হোসেন। তাদের নিবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় ১৯৭০ সালে গৌরাঙ্গ মন্দিরের নাটমন্দিরের জমি ক্রয় করে নির্মাণ করা হয় নতুন ওদাতালা ভবন। আজও তারা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি সমান যত্নবান। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রাণ, নতুন যুবশক্তি। এখন লোহাগড়া পৌরসভায় উন্নীত হয়েছে। পৌরসভা ও উপজলোর যৌথ চেষ্টায় শতাব্দী প্রাচীন লোহাগড়া রামনারায়ন পাবলিক লাইব্রেরি নবযুগের চাহিদা পূরণে সর্থ হবে।
বই, জাতীয় ্ও আঞ্চলকি দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী পাঠরে পাশাপাশি টেলিভিশন দেখার সুযোগ আছে এখানে। পুস্তক সংগ্রহ সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। বহু সংখ্যক পুরোনো সাময়িক পত্র ছাড়া্ও বেঙ্গল এডমিনিস্ট্রেশন, ক্যালকাটা রিভিউ, দুষপ্রাপ্য বসুমতি, প্রবাসী, ভারতবর্ষ ধুমকেতু, ৫০ বছরের পুরোনো লেঅকনাথ পঞ্জিকা, তুলট কাগজ ও তালপত্রে লিখিত পুরোনো পান্ডুলিপি এখানে সংরক্ষিত আছে।
কালের আবর্তে লোহাগড়ার বহু গৌরবগাথা আজ অতীত। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসেবে উন্নত শির শতবর্ষ বয়সী লোহাগড়া রামনারায়ন পাবলিক লাইব্রেরি নবগঙ্গা তীরে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় উদ্ভাসিত করে প্রতিদিন।
আমিরুল আলম খান : শিক্ষাবিদ।