
Home ঐতিহ্য (Tradition) > কালিয়ার পিতলের রথ - আপডেট চলছে
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86727 বার পড়া হয়েছে
কালিয়ার পিতলের রথ - আপডেট চলছে
নড়াইল জেলার কালিয়ার বিখ্যাত ৮০মন ওজনের পিতলের তৈরী রথ চুড়ান্ত অবহেলায় ধ্বংসের মুখে অযত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একটু একটু করে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ এই পিতলের রথ। প্রতিদিন দেশ- বিদেশ থেকে বহু মানুষ আসেন এই রথ দেখতে। পর্যটক ও দর্শনার্থীরা এই রথটিকে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রথ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। উনবিংশ মতাব্দীর গোড়ার দিকে কালিয়ার সেন পরিবার এই দৃষ্টিনন্দন রথ তৈরী করেন। সে সময় কালিয়ার সেন পরিবার ছিল এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবার। একই পরিবারের ১৮ জন সদস্য ব্রিটিশ সরকারের আই সি এস অফিসার ছিলেন। সেন পরিবারের কৃতী সন্তান ভামিনী রঞ্জন সেন ছিলেন ব্যারিষ্টার। তিনি নিজ বাড়িতে ব্রহ্মময়ী আশ্রম ও দেবত্র বাটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্রহ্মময়ী আশ্রম ও ও দেবত্র বাটিতে ব্রারিষ্টার ভামিনী রঞ্জন সেন চারটি মন্দির নির্মাণ করেন। এগুলো হলো- জগন্নাথ দেবের রথ মন্দির, শিব মন্দির, ব্রহ্মময়ী মন্দির ও নারায়ণ মন্দির।
পিতল দিয়ে ৮০ মন ওজনের নকশা ও কারুকার্যখচিত একটি নয়নাভিরাম রথ তৈরী করে জগন্নাথ দেবের রথ মন্দিরে রাখা হয়। সে সময় এখানে বিশাল রথযাত্রা ও মেলা অনুষ্ঠিত হতো। বিরাট উৎসবে টানা হতো রথ। এই রথ একনজর দেখতে হাজার হাজার মানুষ আসতেন কালিয়ার সেন বাড়িতে। চারদিকে এই রথের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে। রথযাত্রার সময় সেন পরিবারের সবাই কালিয়ায় এসে মিলিত হতেন। চারটি চাকার উপর একটি বেদি। এই বেদীর ওপর পুরো রথটি তৈরী করা হয়েছে দ্বিতলবিশিষ্ট এ রথের প্রথমতলা চতুর্ভুজ আকৃতির। দ্বিতলবিশিষ্ট এ রথের প্রথমতলা চতুর্ভূজ আকৃতির দ্বিতলটি M¤^yR আকৃতির। রথের অগ্রভাগে রয়েছে দুটি পিতলের ঘোড়া। ঘোড়া দুটির ঠিক পিছনে রয়েছে। রতের সারথি। রথের মূল আসনে জগন্নাথ দেব বলরাম ও শুভদ্রার মুর্তি স্থাপন করা হয়েছে। রথের চতুর্ভূজ আকৃতির বাইরের অংশের কার্ণিশ জ্যামিতিক নকশার সারি দিয়ে অলংকৃত। এই অংমের সুদৃশ্য বালকনির মধ্যেই রয়েছে দশ অবতারের মুর্তি। রথের চারদিকে ছড়িয়ে - ছিটিয়ে রয়েছে হিন্দুদের প্রায় সব দেব দেবী ও মুনি ঋষিদের মুর্তি। M¤^y‡Ri ওপরে ছিল মনোরম চুড়া।
৮০ মন ওজনের এই ঐতিহ্যবাহী রথ থেকে সোনার চুড়া ও অসংখ্য দেবদেবীর মুর্তি চুরি হয়ে গেছে। কালের পরিক্রমায় রথের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর এই রথের জৌলুস নেই। ৩০-৩৫ বছর আগে রথের চাকা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে রথ টানা হয় না। রথের বেশ কিছু অংশ মরিচা ধরে ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও এর অপূর্ব নির্মাণশৈলী দেখতে এখনো মানুষ কালিয়ায় আসেন। আষাঢ় মাসে রথযাত্রা উপলক্ষে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি এখনো বসে। মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় পূজা।
ব্যারিষ্টার ভামিনী রঞ্জন সেন নারী শিক্ষা বিস্তার কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মময়ী আশ্রমে মহিলা সমিতি ও ব্রহ্মময়ী পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঠশালায় এলাকার মহিলারা পড়াশোনা করতেন। মহিলা সমিতিতে মহিলারা সেলাই প্রশিক্ষণ নিতেন। এর পাশাপাশি ব্রহ্মময়ী আশ্রমে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। ভামিনী রঞ্জন সেন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর চিতাভষ্ম কালিয়ায় নিয়ে আসা হয়। মন্দিরের পাশে সমাধীসৌধ নির্মাণ করে সেখানে চিতাভস্ম রাখা হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সেন পরিবারের প্রায় সবই ভারত চলে যান। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত সেন পরিবারের সদস্যরা পূজার সময় নিয়মিত কালিয়ায় নিজ বাড়িতে আসতেন। দুর্গাপূজা ও রথ যাত্রায় সামব্যাপী চলত উৎসব। সেন পরিবারের যাতায়াত বন্ধ হওয়ার পরই তাদের মন্দিরের দৈনদশা শুরু হয়।
জগন্নাথ দেবের রথ মন্দিরের এখন জীর্ণদশা। মন্দিরের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ইটের গাথুনি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ছাদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। যে কোন মুহুর্তে মন্দিরটি ধসে যেতে পারে। শিব মন্দির , ব্রহ্মময়ী মন্দির ও নারায়ণ মন্দিরের আশপাশ ঝোপ জঙ্গলে ভেসে গেছে। এসব মন্দির ও দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে। ভামিনী রঞ্জন সেনের বসতবাড়িতে গড়ে উঠেছে শহীদ আবদুস ছালাম কলেজ। ওই কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ভামিনী রঞ্জন সেনের মূল বাসভবন মহিলা সমিতি, পাঠাগার ও ব্রহ্মময়ী পাঠশালার ভবনে বসবাস করছেন, যা ব্রহ্মময়ী আশ্রম ও দেবত্র বাটির ক্যাম্পাসে অবস্থিত। ব্রহ্মময়ী আশ্রম ও দেবত্র বাটির ক্যাম্পাসটি মন্দিরের ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দেওয়া হলে মন্দিরগুলোর পাশাপাশি বিখ্যাত রথটি সংস্কারে আগ্রহী স্থানীয়রা। গড়ে তুলতে চায় পর্যটন স্পট। পর্যটক ও দর্শনার্থীরা এখানে এসে জানতে পারবেন বিখ্যাত রথ ও ব্যারিষ্টার ভামিনী রঞ্জন সেনের পরিবার সম্পর্কে। মন্দিরের পুরোহিত কালীপদ ভট্টাচার্য ৪০ বছর ধরে মন্দিরে পূজা করে আসছেন। আগলে রাখার চেষ্টা করছেন এই সম্পদগুলো। বিনিময়ে কোন অর্থ তিনি পাচ্ছেন না। এটি রক্ষায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে সময় তিনি কিছু টকাকা দেন। তার মত্যুর পর আর কেউ এটি রক্ষায় এগিয়ে আসেননি।
চুড়ান্ত অবহেলায় ঝোপ - জঙ্গলের মধ্যে নষ্ট হচ্ছে এই পুরাকীর্তিগুলো। জরাজীর্ণ দশার মধ্য দিয়ে আর কত দিন এই মনোরম স্থাপত্য শিল্প টিকে থাকতে পারবে না নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা এগুলো রক্ষার দাবী জানিয়েছেন।