
Home ঐতিহ্য (Tradition) > যশোরের ঐতিহ্যবাহী চিরুনী শিল্প
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86764 বার পড়া হয়েছে
যশোরের ঐতিহ্যবাহী চিরুনী শিল্প
চিরুণী শিল্পে যশোরের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। এখানকার কারিগরদের তৈরি চিরুণী নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের গুণেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। বয়সে প্রবীণদের মণিকোঠায় এই ঐতিহ্যের কথা সমুজ্জ্বল থাকলেও, কালের আবর্তে আমাদের তরুণ প্রজন্ম তা ভুলে যেতে বসেছে।
বিশ্বখ্যাত যশোরের হাড়ের চিরুণীর কথা বলতে গেলে ঢাকার মসলিন কাপড়ের প্রসঙ্গ চলে আসে। ইংরেজ শাসনামলে জগদ্বিখ্যাত ঢাকায় মসলিন শিল্প ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যিক চক্রান্তে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও যশোরের হাড়ের চিরুণী পেয়েছিল ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতা।
যশোরের হাড়ের চিরুণীর ইতিহাস অতি প্রাচীন। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ও প্রচলিত লোকজ শ্লোক বিশ্লেষণ করে জানা যায়, সভ্যতার উৎকর্ষতার সাথে সাথে মানুষ তার রূপ ও কেশ পরিচর্যায় নানা উপকরণের সাহায্য নিত। ইতিহাসে দেখা যায়, প্রাচীণ রাজাদের অন্দর মহলের ব্যবহার্য অনেক জিনিসের মধ্যে কেশ বিন্যাসে ব্যবহৃত হত চিরুণী। আর এগুলো ছিল বিভিন্ন জীব-জন্তু'র হাড়ের তৈরি।
বর্তমান যশোর জেলা এক সময় স্বাধীন রাজ্য ছিলো। এখনকার আয়তন থেকে তা ছিল চল্লিশ গুণ বড়। রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলো এই রাজ্যের রাজা। ১৪৯৮ সালে ইটালী ও পর্তুগীজ বণিকদের সাথে রাজা প্রতাপাদিত্য যেসব পণ্য বিনিময় করেছেন, তারমধ্যে যশোরের হাড়ের চিরুণীর বিবরণ পাওয়া যায়। অভিজাত এ চিরুণী ছিল সোনা ও রুপা দ্বারা কারুকার্য খচিত।
হাড়ের চিরুণীর মধ্যে সবচেয়ে দামী ছিল হাতীর দাঁতের চিরুণী। এছাড়া হরিণের শিং দিয়ে তৈরি নানা বন্যাকৃতির চিরুণী ছিলো অভূতপূর্ব। এই চিরুণীর চাহিদা ছিলো প্রচুর। গরু-মহিষ ও অন্যান্য জীব-জন্তর হাড় দিয়ে তৈরী চিরুণীরগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত সস্তা। জনশ্রুতি আছে, গন্ডারের শিং দিয়ে তৈরী চিরুণীগুলো ছিলো সোনার চেয়েও দামী। যা রাজ-রাজারা তাদের রাজকণ্যাদের উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করতো।
ইতিহাসে দেখা যায়, হাড়ের চিরুণী তৈরীর জন্য হাতির দাঁত ও বিভিন্ন জীব-জন্তুর শিং ছিলো প্রধান কাঁচামাল। এ জন্য রূপদিয়া বন্দর ও সতীঘাট গঞ্জের নদীর তীরে বসতো হাড়ের পাইকারী বাজার। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বণিকেরা নানা জায়গা থেকে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে এই হাড় সংগ্রহ করে এখানে এনে বিক্রি করতো। এই হাড়কে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন আকৃতি দেয়া হতো। তারপর একপাশ বা উভয় পাশ চিকন-চিকন ফালি করে কেটে তা কারিগরদেরকে সরবরাহ করা হতো। এই কাজে জড়িতরা ছিলেন ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ। চিরুণী ব্যবসায়ীরা ঋষি সম্প্রদায়ের কারিগরদের দিয়ে চিরুণী তৈরী করে সোনারুদের দিয়ে চিরুণীতে সোনা ও রূপার কারুকার্য খচিত করাতো। এতে চিরুণীগুলো আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো।
হরেক রকমের এই সব চিরুনী বিভিন্ন বণিকের হাত ঘুরে তা ছড়িয়ে পড়তো সারা বিশ্বে। ইংরেজ শাসনামলে যশোরের হাড়ের চিরুণীর কদর বহুগুণ বেড়ে যায়। বাংলায় অন্যান্য লোকজ শিল্প ইংরেজদের চক্রান্তের শিকার হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লেও একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো যশোরের চিরুণী শিল্প। এমনকি ইংরেজ বণিকেরা এই শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল বলে এখানে চিরুণী শিল্প ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছিল। চিরুণীর গায়ে তখন থেকেই ইংরেজীতে যশোর নামটি খোদাই করে বাজারজাত করা শুরু হয়। ফলে যশোর নামটি ক্রমান্বয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ শাসনের পৌনে ২শ’বছর ধরেই যশোরের হাড়ের চিরুণী সারা বিশ্বের চিরুণীর বাজারে ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
যশোরের চিরুণীর সুখ্যাতির সাথে সাথে এর বাজার চাহিদা দেখে তখন ইংরেজ ও ফরাসি বণিকেরা এই দেশ থেকে কারিগর নিয়ে গিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চিরুণীর কারখানা গড়ে তোলে। কিন্তু যশোরের চিরুণীর চাহিদার কারণে ওই সমস্ত চিরুণীর গায়েও ইংরেজিতে যশোর নামটি খোদাই করে তারা বাজারজাত করতো।
ইংরেজ শাসনের অবসানের সাথে সাথে যশোরের চিরুণী শিল্পের সংকট শুরু হয়। কারিগরেরা গরু ও মহিষের শিং দিয়ে আজ অবধি চিরুণী তৈরী অব্যাহত রাখলেও অভিজাত চিরুণীর বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ার কারণে একে একে বন্ধ হয়ে যায় বড় বড় চিরুণী কলগুলো। ফলে এই শিল্পে নিয়োজিত কারিগরেরা অনেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাড়ি জমান। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে চামড়া কেনা-বেঁচায় ও প্রক্রিয়াজাতকরণে জড়িয়ে পড়েন।
পাকিস্তান আমলে কিছু অবাঙ্গালী চিরুণী শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন । বাংলাদেশ স্বাধীণ হওয়ার পর কিছু উৎসাহী বাঙ্গালী ব্যবসায়ী চিরুণী শিল্পকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেন। কিন্ত সস্তা প্লাষ্টিকের চিরুণী ক্রমেই হাড়ের চিরুণীর বাজার দখল করে নেয়।
যশোরের হাড়ের চিরুণী আজ বিলুপ্ত প্রায়। পৃথিবীময় এর যশ ও খ্যাতি এখন ইতিহাসের বিষয়। অভিজাত এ হাড়ের চিরুণী যশোর তথা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও সারা বিশ্বে এখনো যশোর খচিত বিভিন্ন হাড়ের চিরুণীর কদর রয়েছে। এখনো ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে ইংরেজিতে যশোর খচিত হাঁড়ের চিরুণী দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি অনেকে প্লাষ্টিকের চিরুণীর গায়েও ইংরেজীতে যশোর লেখা খচিত থাকতে দেখা যায়।
লেখক: মুরসালিন নোমানী,
সিনিয়র রিপোর্টার,
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)
সদস্য, বাংলা একাডেমী।