
Home ঐতিহ্য (Tradition) > যশোরের ঐতিহ্য খেজুরের রস-গুড়-পাটালী
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86762 বার পড়া হয়েছে
যশোরের ঐতিহ্য খেজুরের রস-গুড়-পাটালী
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জেলা যশোর। এই ঐতিহ্যের একটি অংশ হলো যশোরের খেজুরের রস এবং খেজুরের গুড়। শীত কালের কথা আসলেই রস-গুড়-পাটালীর কথা চলে আসে। যশোর অঞ্চলে শীত মানেই রস-গুড়-পাটালী। যশোরের খেজুরের রসের সুবিদিত ঐতিহ্য রয়েছে। প্রকৃতির সৌরভযুক্ত এই রস স্বাদে খুব সুস্বাদু। সুপ্রাচীন কাল থেকেই শীতকালিন খেজুরের রস এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় উপাদেয় ও লোভনীয় বস্তু হিসাবেই বিবেচিত। আধুনিককালে বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেছে, সুমিষ্ট তরল খেজুরের রসের খাদ্য গুন খুবই পুষ্টিকর। যে কোন বয়সের যে কোন রুচির মানুষের কাছে খেজুরের রস অত্যন্ত প্রিয়।
শীতের সকালে গাছি যখন রস নিয়ে বাড়িতে আসেন তখন রস খাওয়াকে কেন্দ্র করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে একপ্রকার প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। কার আগে কে খাবে তা নিয়েও অনেক সময় তাদের মধ্যে ছোটখাট হুল্লোঢ় লেগে যায়। তাছাড়া রস দিয়ে তৈরী পায়েস ও পিঠা যে কি মজা তা চৌগাছার লোকজন ভাল করেই জানেন।
ব্রিটিশ আমলে, এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত যশোরের খেজুরের গুড়ের চিনির খুব নামডাক ছিল। এই চিনি সামান্য লালচে কিন্তু বর্তমানে আখের চিনির মত ঝরঝরে ছিল। গ্রামে যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভাল ছিল তাদের বাড়ীতে হ্মুদ্র হ্মুদ্র খেজুরের চিনি শিল্প গড়ে উঠেছিল। এই চিনি গরু গাড়ীতে করে কেশবপুর এবং নওয়াপাড়ায় নিয়ে বিক্রি করা হত। বৃটিশ বণিকরা এই চিনির প্রধান ক্রেতা ছিল।
১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ হাউজ চৌগাছার তাহেরপুরে খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রকৃতিগতভাবে এই অঞ্চলের পানি মিঠা। একারণেই এই অঞ্চলের খেজুরের রস তুলনামূলক বেশি মিষ্টি ও সুস্বাদু।
খাজুরার পাটালির কথা এখনো শোনা যায়। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আখের চিনিতে বাজার সয়লাব হওয়া এবং জনসংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে যে সমস্ত জমিতে খেজুরের গাছ ছিল তা কেটে ফেলে সেখানে আবাদী জমি হিসাবে অন্যান্য ফসলের চাষ শুরু হয়। ফলে খেজুরের গাছ সংখ্যায় কমে গিয়ে আজ এমন একটা অবস্থায় এসেছে যে, যশোরের সেই ঐতিহ্য অনেকটা গল্পে পরিণত হয়েছে।
তবে আশার কথা হচ্ছে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে যশোরের এক হ্মুদ্র শিল্পপতি খেজুরের রসকে প্রক্রিয়াজাত করে ইউরোপে বাজারজাত করছে। ফলে এক সময় যে ইউরোপীয়রা যশোরের খেজুরের গুড় বা চিনির স্বাদ নিত, আজ তারা আসল রস পাচ্ছে, কিন্তু তা অত্যন্ত সীমিত পরিমাণে। যদি আরও শিল্পপতি এগিয়ে আসেন তবে এ শিল্পটি ব্যপকতা লাভ করবে এবং বৈদশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে । তাছাড়া যশোরের এ গৌরব সারা বিশ্বে পৌছে দেওয়াও সম্ভব হবে।
২০১২ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, শীত মৌসুমে খাজুরা বাজারে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ মণ গুড় বা পাটালি বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আসেন এ বাজারে। শখের বসেও এখান থেকে অনেকে কিনে নিয়ে যান গুড়-পাটালী। অনেক প্রবাসী এখানে আসেন মিষ্টি গুড়ের স্বাদ নিতে। নতুন মেয়ে জামাই বাড়িতে পাঠাতে অনেকে নলেন গুড়ের খোঁজে আসেন এ বাজারে। যারা সুস্বাদে বিভোর হতে চান পাটালি ও গুড়ের জন্য, তারা নিশ্চয় জানেন খাজুরা বাজারের নামটি। এই এলাকাতেই পাওয়া যায় দেশসেরা নলেন গুড়।
নলেন গুড় প্রস্তুত প্রণালী:
নলেন গুড় আসে এক বিশেষ ধরণের খেজুর রস থেকে, যাকে এ অঞ্চলের মানুষ নলেন রস বলে থাকে। নলেন গুড় থেকে তৈরি হয় সন্দেশ, ক্ষির-পায়েস প্রভৃতি। আশ্বিনের শেষের দিকে খেজুর গাছকে প্রস্তুত করতে হয় রস আহরণের জন্যে। গাছের বাকল কেটে "গাছ তোলা" হয়। গাছ তোলা শেষে গাছ কাটার পালা। কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে ধারালো গাছিদা দিয়ে সপ্তাহে নির্দ্দিষ্ট দিনে গাছ কেটে রস আহরণ করা হয়।
রস পেতে হলে কিছু কাজ করতে হয়। গাছের উপবিভাগের নরম অংশকে কেটে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয় বাঁশের তৈরি নালা। গাছের কাটা অংশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রস এনে নল দিয়ে ফোটায় ফোটায় জমা হয় ভাঁড়ে। প্রথম রস একটু নোনা। গাছি এক কাটের পর বিরতি দেন। কিছুদিন বিরতির পর আবার কাটেন। এবারের রস সুমিষ্ট, সুগন্ধে মৌ মৌ চারিদিক। এর সুবাস আর স্বাদ দিতে ভিড় জমায় পিঁপড়া, মৌমাছি, পাখি ও কাঠবিড়ালী। এই রসের নামই নলেন রস। আর এটি কেবল যশোরের খাজুরা এলাকাতেই সম্ভব।
এ অঞ্চলের মানুষ রস ও গুড় দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের পিঠা। পিঠার পাশাপাশি বানানো হয় নানা ধরণের পাটালি। আকৃতি, রং ও স্বাদের দিকেও তাতে থাকে ভিন্নতা। এখানকার মানুষ নারিকেলের পাটালি বিশেষ পছন্দ করেন। এই পাটালি পাঠানো হয় তাদের স্বজন-আত্মীয়-পরিজনকে। আর এই বিশেষ ধরণের পাটালি কেবল এখানকার কারিগররাই বানাতে পারেন। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাইরে এই পাটালির আবরণ থাকে শক্ত। কিন্তু ভেতরটা গলে যাওয়া মোমের মত। এখানকার মানুষ বংশানুক্রমে এ পাটালি তৈরি করে আসছেন। সেসব বিক্রি হচ্ছে এ অঞ্চলসহ সারাদেশে। খেজুর গাছের স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে ইটের ভাটায় অবাধে গাছ পোড়ানোর কারণে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, এই অঞ্চলের মাটি সাধারণত বেলে দোঁ-আশ। আর পানিতে লবনাক্ততা নেই। ফলে গাছের শিকড় অনেক নিচে পর্যন্ত যেতে পারে। সব মিলিয়ে জলবায়ু উপযোগী যশোরের খাজুরা, বাঘাপাড়া, চৌগাছা, মাগুরার শালিখার খেজুরের রস সুগন্ধি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে।
২০১১ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, এ এলাকায় এক ভাঁড় রস জালানোর পর তাতে গুড় হয় এক কেজি। যার দাম একশ’ থেকে ১শ’২০ টাকা। পাটালীও হয় একই পরিমাণ। জেলার সর্বত্রই রয়েছে খেজুর গাছের আধিক্য। প্রতিটি গ্রামে দেখা যায় শীত মৌসুমে খেজুর গাছ কেটে রস আহরনের দৃশ্য। এসব খেজুর গাছ থেকে অনেকটা খরচহীন ভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে গুড় ও পাটালী। তবে জেলার সদর উপজেলার খাজুরার তৈরি গুড়ের রয়েছে বাড়তি কদর। এখানকার গুড় দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে যাচ্ছে, সেখানে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। খাজুরা এলাকার বামনডাঙ্গা, তেজরোল, রাজাপুর গ্রামে গুড় উৎপাদন বেশি হয়। এসব গ্রামের অধিকাংশ কৃষক খেজুর গাছ কাটার সাথে জড়িত। আশেপাশের গ্রামগুলোতে খেজুরের রস, গুড় ও পাটালী উৎপাদনকে ঘিরে খাজুরা বাজারে গড়ে উঠেছে স্থায়ী কয়েকটি দোকান। তাছাড়া এখানে রাস্তার পাশে গুড়ের ভাঁড় আর পাটালীর ডালি নিয়ে বসেন অসংখ্য বিক্রেতা।
লেখক: মুরসালিন নোমানী
সিনিয়র রিপোর্টার, বাসস
সদস্য, বাংলা একাডেমী।