
Home ঐতিহ্য (Tradition) > নড়াইল জেলার ঐহিত্যবাহী মন্দির
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86830 বার পড়া হয়েছে
Tample of Narail
নড়াইল ও হাটবাড়িয়া মন্দির
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রূপরাম দত্ত সরকারের পুত্র কালী শঙ্কর রায় নড়াইলের জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। কালী শঙ্করের পৌত্র দুর্গাদাস ও গুরুদাস হাটবাড়িয়া গ্রামের বসতি স্থাপন করেন। এই বংশের রতন বাবুর সয়ম হইতে নড়াইল বাবুর বাড়ী ও হাটবাড়িয়ায় কতিপয় মন্দির নির্মিত হয় এবং সমারোহের সহিত পূজা পার্বনাদি চলিতে থাকে। বিশেষ করিয়া দুর্গোৎসব অনুষ্ঠান দেশ বিদেশের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। এই বংশের কালীপ্রসন্ন বাবু ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে সর্বমঙ্গলা নাম্নী একটি কালীকা মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শ্বেত মর্মর নির্মিত মন্দির স্থাপন করেন। মন্দিরটি এখনও বিদ্যমান। জমিদার বংশের কেহ এখানে না থাকিলেও স্থানীয় ভক্তগণ ইহার রক্ষণাবেক্ষণ এবং পূজা উৎসবাদি সম্পন্ন করিতেছেন।
রূপগঞ্জ কালীবাড়ী
এই কালীবাড়ীটিও বহু পুরাতন। মন্দিরে নিত্য পূজা হয় এবং বাৎসরিক অনুষ্ঠান মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়।
শাল নগর মন্দির
লোহাগড়া থানাধীন ৩নং শালনগর ইউনিয়মের অন্তর্গত শাল নগর গ্রামে লড কর্ণওয়ালিসের আমলে যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তখনই চাকলানবীশ বাবুদের বাড়ী দালান কোঠায় ভরিয়া ওঠে। তখন বাড়ীতে দূর্গাপূজা হইত ১১ খানা। পূজা মণ্ডপে ধ্বংসাবশেষ এখানও বিদ্যমান।
জোড় মন্দিরে গোবিন্দ দেব বিগ্রহ ছিল। মন্দিরটি এখনও বিদ্যমান। ছয় একর জমির উপর একটি বিরাট দীঘি ছিল। ইহা সারনাথ বাবুর দীঘি নামে খ্যাত ছিল। বর্তমানে ইহা প্রায় ভরাট হইয়া গিয়াছে।
বাড়ীতে রথযাত্রা উপলক্ষে বিরাট মেলা বসিত। শিব মন্দির তিনটি। এইগুলি এখন ধ্বংস প্রায়। দোল মন্দিরে মহা আড়ম্বরে দোল উৎসব সম্পন্ন হইত। মন্দিরটি স্বর্গীয় মহাত্ম রামভদ্র চাকলা নবীশের স্মৃতি স্মরণে ১১৩০ সালে স্থাপিত হয়। ১৩৪৭ সালে উহার সংস্কার সাধন করা হয়।
এখানে কালীপূজাও সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হইত। বর্তমানে চাকলা বংশধরগণ ইহার স্মৃতি বহন করিয়া চলিতেছেন মাত্র।
রায়গ্রাম জোড়বাংলা মন্দির
মোহাম্মপুর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে নবগংগা নদীর তীরে অবস্থিত রায়গ্রাম নামক স্থানে একটি জোড়বাংলা মন্দির ছিলো। এটি ভুষণার রাজা সীতারামের জোড় বাংলার অনুকরণে নির্মিত। সীতারামের প্রধান সেনাপতি ছিলেন মেনাহাতি। মেনাহাতির কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামশঙ্কর রায়গ্রামে একটি সুন্দর জোড় বাংলা মন্দির নির্মাণ করে নারায়ণ বিগ্রহ স্থাপন করেন এবং পাশে একটি শিবমন্দিরও নির্মাণ করেন।
জোড়বাংলা মন্দিরটি ২টি দোচালা ঘরের পাকা ছাদের সংযোগে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি বড়ই সুন্দর ছিল। এটি সীতারাম কর্তৃক নির্মিত মন্দিরের অনুরূপ। প্রত্যেক দোচালা ঘরের বাহিরের আয়তন ২৮”/২২”-১০”। মন্দিরের মাপ ১৪”-৪”/১৪”-৪” ইঞ্চি। মন্দিরের সামনের দিকে তিনটি প্রবেশ পথ ছিল, যা অধবৃত্তাকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত। প্রবেশপথে পরে বারান্দা ছিল। বারান্দার পরে ভূগৃহ ছিল। শিবমন্দিরে উৎকীর্ণ শ্লোকঃ ষষ্ঠ বেদাঙ্গ চন্দ্রমস শাকে শ্রী শংকরালয় আকারি শংকরা খ্যেন ঘোষে নাপি সুভক্ষিতঃ অর্থাৎ (ষষ্ঠ=৬. বেদ=৪, অঙ্গ =৬, চন্দ্র=১ অশংস্য বামাগতিতে ১৬৪৬ শক বা ১৭২৪ খ্রীঃ) ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে ১৬৪৬ শতাব্দীতে/১১৩১ বঙ্গাব্দে রাম শংকর কর্তৃক মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। জোড় বাংলা ও শিব মন্দির বর্তমানে ধ্বংসে পরিনত হয়েছে।
শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালিমন্দির
লোহাগড়া উপজেলার লক্ষ্মীপাশায় নবগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। আনুমানিক ১০৫০ সালে ঝিকরগাছা উপজেলার কামদেবরায় নামক একজন কালিসাধক লোহাগড়া উপজেলার জয়পুর শ্মসানঘাটে আশ্রম তৈরি করে কালিদেবীর মুর্তি স্থাপন করতঃ মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি নিজেই এর সেবাইত হন। কথিত আছে যে তৎকালীন নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে দেবীর সাহায্য কামনায় গভীর রাতে জনৈক ভক্ত দেবীর পায়ে ‘নরবলী’ দিয়েছিলেন। নীল কুঠিয়াল সাহেব উইলিয়াম জোনস মারা যান এবং বাংলা ১২৭৫ সালে লক্ষ্মপাশা থেকে নীলকুঠি উঠে যায়। (সূত্র যশোরের ইতিহাস.....)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী মন্দিরের প্রভুত ক্ষতিসাধন করে এবং দেবীর মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। ইতিপূর্বে তিনবার মন্দিরের সংস্কার করা হয় এবং সবশেষে ১৯৯১ সালে বৃহদাকারে সংস্কার করা হয়। বর্তমানেও দূর দুরান্ত থেকে ভক্তগণ এখানে আগমন করেন।
লক্ষ্মীপাশা শ্রীশ্রী সিঁদ্ধেশ্বরী মন্দির
এই মন্দিরটি সারা বাংলাদেশ ভিত্তিক হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ইহা আনুমানিক ১০৬০ বঙ্গাব্দে স্থাপিত হয়। এখানে একটি মনোরম কালী মন্দির, একটি শিব মন্দির, একটি নাট মন্দির ও একটি ঘাট বাঁধান সুন্দর পুকুর আছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে স্থানীয় জনসাধারণ উহা সংস্কার করেন। মন্দিরে নিত্য পূজা হয় এবং বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়।
লক্ষীপাশা কালি মন্দির
লোহাগড়ার লক্ষীপাশা কালিবাড়ি বাংলাদেশের প্রাচীন কালিবাড়ির মধ্যে অন্যতম। কামদেব নামক জনৈক সিদ্ধিপুরুষ এই কালি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বর্তমান কালি মন্দিরের দক্ষিণে হরিতকী গাছের নিকট একটি কালিমুর্তি স্থাপন করেছিলেন। আস্তে আস্তে এই কালি মুর্তি বিভিন্ন রাজা ও জমিদারদের অনুকুলে বর্তমান মন্দিরে পরিনত হয়। কালিমন্দিরের পাশে শিব মন্দির ও নাটমন্দির আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী মুর্তিটিকে গুলি করে ধ্বংস করে। বর্তমানে কালিমুর্তি নির্মাণ করে পুজা দেওয়া হচ্ছে। জনশ্রুতি আছে যে, কহুকাল পুর্বে এই মন্দিরে নরবলি দেওয়া হত।
লোহাগড়া শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেব মন্দির
এই মন্দিরের বিখ্যাত রথখানি আনুমানিক বাংলা ১১২১ সালে স্বর্গীয় বিদ্যাধর রায় কর্তৃক নির্মিত হয়। রথটি ছিল কাঠের তৈরী এবং সুবৃহৎ। প্রতি বৎসর রথযাত্রা উপলক্ষে মহা- ধুমধামের সঙ্গে পূজা অর্চনা হইত এবং মেলাও বসিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাক সেনাগণ উহা বিধ্বস্ত করে। ১৯৮০ সালে স্থানীয় ধর্মপ্রাণ শ্রী অজয় কুমার মজুমদার ও তাহার সহযোগী ব্যক্তিগণ রথখানি পুনঃনির্মাণ করিয়া মন্দিরে স্থাপন করেন। তদবধি প্রতি বৎসর রথযাত্রা উপলক্ষে অনুষ্ঠান হয় এবং মেলা বসে।
লোহাগড়া জোড় বাংলা মন্দির
লোহাগড়া আদর্শ কলেজের উত্তর পার্শ্বে লোহাগড়া রাধাগোবিন্দ মন্দির অবস্থিত। মন্দিরটি খুবই প্রাচীন সম্ভবত আড়াইশত বৎসরপুর্বে নির্মিত। মন্দিরের খিলান ছাদ ভগ্নপ্রায় অবস্থায় আছে। মন্দিরের দেয়াল পাতলা টালির ন্যায় ইটের তৈরি। দেয়ালে নানা রকম নকশা আঁকা রয়েছে। নকশাগুলো টেরাফাটা চিত্রনামে পরিচিত মন্দিরের টালি সাদৃশ্য ইটগুলি এখনও কালের প্রবাহে টিকে আছে।
শেখহাটী ভুবনেশ্বরী দেবীর মন্দির
নড়াইল মহকুমার পশ্চিমাঞ্চলে শেখাটী গ্রামে ভুবনেশ্বরী দেবীর মন্দির অবস্থিত। মন্দিরটি আনুমানিক ১৫৮১ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। মন্দিরটি দীর্ঘ দিনের বিধায় জীর্ণশীর্ণ হইয়া গিয়াছে। মন্দিরে নিত্য পূজা হয়। তাহা ছাড়া প্রতি বৎসর ১ মাঘ দেবী ভূবনেশ্বরীর বাৎসরিক পূজা হয়। এই উপলক্ষে এখানে এক বিরাট মেলা বসে। দুর দূরান্ত হইতে বহু হিন্দু নরনারী ঐ দিন দেবী দর্শন করিতে আসেন।
কথিত আছে একটি পুকুর হইতে এই মূর্তিটি পাওয়া যায়। রাজা প্রতাপাদিত্যের অন্যতম সেনাপতি কালিদাস রায় এখানে বসতি স্থাপন করিবার সময়ে উক্ত ভুবনেশ্বরী দেবীর সেবার ব্যবস্থা করেন। সেন রাজত্ব কালে নির্মিত এ মূর্তিটি ভাস্কর্য্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন।
এই মন্দির ভুবনেশ্বরী মাতার মূর্তির পার্শ্বে একটি বাসুদেব মূতি ছিল। বাসুদেব বিগ্রহটি ৩০ ইঞ্চি লম্বা ও ২০ ইঞ্চি প্রস্থ কষ্টি পাথরে তৈরী। বিগত ২৫/৩/৮১ তারিখে বিগ্রহটি কে বা কাহারা চুরি করিয়া লইয়া যায়। বহু দুর দুরান্ত থেকে মানুষ এই দেবী দর্শন করতে আসে। বর্তমানে মন্দিরটি জীর্ন শীর্ন অবস্থায় টিকে আছে।
বুনোর শীতলা মন্দির
শীতলা দেবী মূলতঃ বসন্ত রোগ নাশিনী দেবী বলিয়া পূজিত। বুনো গ্রামে কুণ্ডু বংশীয় কোন এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি আনুমানিক ১৭৫৬ সালে নিজ ব্যয়ে এই মন্দিরটি স্থাপন করেন এবং মন্দিরে শীতলা দেবী প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে কুণ্ডু বংশীয় শ্রী অমূল্য কুমার কুণ্ডু এবং তদীয় ভ্রাতা ও পুত্রগণ মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন। বর্তমানে ইহার সেবাইত হিসাবে নিযুক্ত আছেন শ্রী খোকন চক্রবর্তী মহাশয়। প্রতিদিন এই মন্দিরে পূজা ও ভোগ প্রদান করা হয়। প্রতি বৎসর বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে শনি ও মঙ্গলবারে এখানে অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয়। এই উপলক্ষে এখানে প্রকাণ্ড মেলা বসে। রামায়ণ কীর্ত্তণ প্রভৃতির আসর বসে।
ইতনা শীতলা মন্দির
এই মন্দিরটি প্রায় ৫০ বৎসর পূর্বে স্থাপিত হয়। মন্দিরে নিত্য পূজা হয়। প্রতি বৎসর মাঘী পূর্ণিমায় উৎসব হয়। বর্তামানে শ্রী গোবিন্দ সরকার এবং শ্রী কালাচাঁদ সরকার মন্দিরের সেবাইত হিসাবে আছেন।
মল্লিকপুর জয়কালী মন্দির
এই মন্দিরে কালীমাতা মূর্তি স্থাপিত আছে। বিগ্রহের নিত্য পূজা হয়। প্রতি বৎসর কালী পূজা উৎসব মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হয়।
দৌলতপুর গৌরাঙ্গ মন্দির
রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত গোরাঙ্গ মন্দিরটি কেন্দ্র করিয়া এখানে ধর্মীয় পরিমণ্ডল সৃষ্টি হইয়াছে। এই মন্দিরে গৌর নিতাই বিগ্রহ স্থাপিত আছে। প্রতিদিন পূজা ও ভোগরাগ হয়। এখানে বহু ভক্ত প্রতিদিন শ্রীকৃষ্ণের নামগানে মত্ত থাকেন।
কালিয়া বেন্দা শিব বিগ্রহ
এখানে বহু প্রাচীন কালের একটি পীঠস্থান আছে। স্থাপিত আছেন শিব বিগ্রহ। প্রতিদিন ভক্তবৃন্দ ইহা দর্শনে আসেন। মহা আড়ম্বরে এখানে বাৎসরিক নীলপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
বারুই পাড়া চণ্ডী মণ্ডপ
এখানে একটি বিরাট চণ্ডীমণ্ডপ স্থাপিত আছে। প্রতি বৎসর মহা ধূমধামের সঙ্গে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং দরিদ্র নারায়ণের সেবা চলে।
তথ্য সূত্র :
যশোরে হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্য
লেখক : শ্রীতারাপদ দাস
সর্বশেষ আপডেট :
১৫.০৫.১১