
Home ঐতিহ্য (Tradition) > মাগুরা জেলার ঐহিত্যবাহী মন্দির
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86829 বার পড়া হয়েছে
Tamples of Magura
মহম্মদপুর মন্দির :
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রাজা সীতারাম রায় মহম্মদপুরে রাজধানী স্থাপন করিয়া ১৬৯৯ সালে সেখানে দশভূজার মন্দির ও কৃষ্ণজীর মন্দির, ১৭০৩ খৃষ্টাব্দে কানাই নগরের হরেকৃষ্ণ মন্দির এবং ১৭০৪ খৃষ্টাব্দে লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির নির্মাণ করেন। রাজা সীতারামের সময়ে মহম্মদপুর, গঙ্গারামপুর, বারুইখালী, পলিতা, নহাটা প্রভৃতি স্থানে বিশিষ্ট পণ্ডিত মণ্ডলী বসবাস করিতেন। তাহারা বহু চতুষ্পাঠি স্থাপন করিয়া ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। রাজা নিজে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ স্থাপনে বিশেষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি চতুষ্পাঠির (টোল) অধ্যাপকদের মসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। তাঁহার সময়ে বহুবিধ জলাশয় স্থাপিত হয়। তাহার মধ্যে রামসাগর ও কৃষ্ণসাগর প্রধান। ১৭১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর রোষে পতিত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইলে তাহার রাজত্বের অবসান হয় এবং তাহার কীর্তিকলাপ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইতে থাকে। পরবর্তীকালে স্থানীয় জনসাধারণের চেষ্টায় প্রাচীন মন্দির সমূহের কতিপয় সংস্কার এবং কতিপয় নতুন মন্দির স্থাপিত হইয়াছে। এখানে পূজা অর্চনা ও উৎসবাদি চলিতেছে।
লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির
মুহাম্মাদপুর দুর্গের ভিতরে সীতা রামের প্রসাদের কিছু দক্ষিণে লক্ষ্মীনারায়ণের বিচিত্র মন্দির অবস্থিত ছিল। অষ্টকোনাকৃতির এই মন্দিরের উপরে সমতল ছাদ ছিল। মন্দিরটি বেশী বড় ছিল না। এই লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির স্থাপনের ব্যাপারে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
সীতারাম ভুষণা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করার জন্য জায়গা খুঁজতে গেলে এক জায়গায় তার ঘোড়ার পা মাটিতে দেবে যায়। অনেক চেষ্টা পরও ঘোড়ার পা তোলা না গেলে স্থানটি খনন করা হয়। খনন করার পর দেখা যায় যে, প্রাচীন মন্দিরের চুড়ায় ঘোড়ার পা আটকে আছে। সেই মন্দিরের ভিতর নাকি লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ ছিল। সীতারাম সে জায়গায় রাজধানী নির্মাণ করার জন্য দুর্গা ও বাসস্থান নির্মাণ করলেন। প্রাচীন মন্দিরের উপরে একটি অষ্টকোনাকৃতির লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির নির্মাণ করে প্রাচীন বিগ্রহটি স্থাপন করেন। মন্দির গাত্রে শিলালিপিতে লেখা লিখঃ লক্ষ্মীনারায়ণ স্থিত্যৈ তর্কাক্ষিরসভুশকে নির্মিতং পিতৃপুপ্যার্থং সীতারামে মন্দিরম অথাৎ [তর্ক = ৬, অক্ষি = ২, রস = ৬
[ভূ=১] অঙ্গের বামদিকে থেকে ১৬২৬ শফ বা ১৭০৪ খৃষ্টাব্দ]
সীতারাম ১৭০৪ খৃষ্টাব্দে পিতৃপুর্ন্যের মানুষে লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতিষ্ঠাকল্পে এই মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরটি বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
পঞ্চরত্ন মন্দির
ভুষণার রাজা সীতারাম কর্তৃক নির্মিত সুখ সাগর ও বাইরের গড়ের পশ্চিমে অবস্থিত কালাইনগর গ্রামে কৃষ্ণসাগরের পাড়েই এ মন্দিরটির অবস্থান ছিল। সীতারাম কর্তৃক নির্মিত মন্দিরের আয়তন ও উচ্চতা অন্যান্য মন্দির থেকে বেশী ছিল। পুর্বদিকে তিনটি প্রবেশ পথ ছিল, যা অর্ধবৃত্তাকারে খিলালের সাহায্যে নির্মিত। এরপরে বারান্দা ছিল। বারান্দার পরে মন্দিরের গর্ভগৃহ ছিল। গর্ভগৃহের উপর একটি ও মন্দিরের চারকোণে চারটি বুড়া বা রত্ন ছিল। মন্দিরে মোট পাঁচটি রত্ন থাকার জন্য মন্দিরটির নাম পঞ্চরত্ন হয়েছিল। গর্ভগৃহের উপর অবস্থিত চুড়াটি খুব উঁচু ছিলো। এখানে রাধা কৃষ্ণের যুগল মুর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। মন্দিরের দেয়াল নানা মুর্তির সাহায্যে অঙ্কিত ছিল। পুর্ব দেয়ালে অঙ্কিত মুর্তি চিত্র বেশী দেখা যেত। মন্দির গার্তে অঙ্কিত কৃষ্ণ ও বনরাম মুর্তি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানের মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
দশ ভুজা মন্দিরে লিখিত ছিল মহী-ভুজ-রাস ক্ষেকী শকে দশ ভুজালয়ম অশারি শ্রীমতা সীতারামায়েন মন্দিরম অর্থাৎ [মহী=১, ভুজ=২, রস=৬ ক্ষৌনী (পৃথিবী) = ১] অঙ্গের রামাগতিতে ১৬২৯ শ্বদ বা ১৬৯৯ খৃষ্টাব্দ।
জোড় বাংলার মন্দির ও দশভুজার মন্দির
মুহাম্মদপুর দূর্গের অভ্যন্তরে সীতারামের প্রসাদের পুর্বদিকে লক্ষ্মীনারায়ণের পুকুরের দক্ষিণে পাড়ে দশভুজার মন্দির ছিল। মন্দির গাত্রের লিপি থেকে জানা যায় যে, ১৬৯৯-১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে (১৬২১ শতাব্দী) এটি নির্মিত হয়েছিল। ভুজা মন্দিরের পুর্ব পার্শ্বে শ্রীকৃষ্ণের জোড় বাংলা মন্দির ছিল। দুটি দোচালা ঘরের পাকা ছাদের সমন্বয়ে তাই রকম জোড় বাংলা মন্দির বেশ কয়েকটা দেখা যায়। মন্দিরটির গাত্রে কোন শিলা লিপি না থাকাই নির্মাণ কাল জানা যায় না। সম্ভবত মন্দিরটি অন্য মন্দিরের সমসাময়িক কালে নির্মিত।
মাগুরা কালী মন্দির
এই মন্দিরটি বহু প্রাচীন। বর্তমানে শ্রীদীপক কুমার রায় চৌধুরী এবং স্থানীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিগণ ইহার সংস্কার সাধন করিতেছেন। মন্দিরে স্থাপিতা কালীমাতা বিগ্রহের নিত্য পূজার ব্যবস্থা আছে। একজন পূজারী বিগ্রহের সেবায় রত আছেন। এখানে প্রতি বৎসর মহাসমারোহে বাৎসরিক দূর্গা পূজা এবং কালী পূজা হয়।
আঠার খাদা শ্মশান কালী মন্দির
এখানে শ্মশানের উপকণ্ঠে স্থানীয় ভক্তবৃন্দের আনুকুল্যে একটি মন্দির স্থাপিত হইয়াছে। মন্দিরে স্থাপিতা শ্মশানকালী মাতার পূজা ও তত্ত্বাবধানের জন্য সেবাইত আছেন।
তালখড়ি রাধাকৃষ্ণ মন্দির
ভক্তচুড়ামণি লোকনাথ গোস্বামী যিনি আজীবন ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া যুগত্রাতা মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্য দেবের সাক্ষাৎ শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া একদিন বাংলার পথে প্রান্তরে হরিনাম বিলাইয়া বেড়াইতেন তাঁহারই প্রচেষ্টায় আজি হইতে প্রায় সাড়ে চারিশত বৎসর পূর্বে স্বীয় জন্মস্থান তালখড়িতে একটি মন্দির নির্মাণ করাইয়া রাধাকৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন করেন। এই মন্দির কেন্দ্র করিয়া এখানে গড়িয়া ওঠে সনাতন ধর্মচর্চার প্রধান কেন্দ্র। ধীরে ধীরে সাধু, সমাগম বাড়িয়া যায়। পূজা, উৎসব আর নামগানে ভরিয়া উঠে মন্দির আর প্রাঙ্গণ। মন্দির সংলগ্ন প্রচুর সম্পত্তি দেব সেবায় অপিঁত হয়। পাকিস্তান আমলে মন্দিরের উন্নয়ন কিঞ্চিৎ স্তিমিত হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মন্দিরটির যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়। বর্তমানে স্থানীয় জনসাধারণ আবার ইহা পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া আনিতে চেষ্টা করিতেছেন। মন্দির পরিচালনার জন্য একটি অছি পরিষদ আছে। এখানে প্রতি বৎসর নানাবিধ ধর্মীয় উৎসব হইয়া থাকে।
এখানে উদাহরণ স্বরূপ কতিপয় মন্দিরের নাম উল্লেখ করিয়াছি। ইহা ছাড়া বহু নাম না জানা মন্দির যশোরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হইয়াছিল। উহাদের মধ্যে অনেকগুলির অস্তিত্ব এখন বিদ্যমান ও অনেকগুলির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইয়াছে। মন্দিরগুলি কেন্দ্র করিয়া যশোরে উল্লেখযোগ্য হিন্দু ঐতিহ্য গড়িয়া উঠিয়াছিল। সে ঐতিহ্য এখনও বিদ্যমান। এই সমস্ত মন্দিরে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। প্রতিদিন বিগ্রহ পূজা, আরতি ও ভোগরাগ চলে। নিত্য পূজা ছাড়াও বাৎসরিক পূজা ও প্রতিষ্ঠার দিবস সম্পাদিত হয়। রাজাও জমিদারদের আমলে দরিদ্র জনসাধারণ এই পূজা উপলক্ষে তাহাদের (রাজা ও জমিদারদের) নিকট হইতে অন্ন, বস্ত্র ও অর্থ সাহায্য লাভ করিতেন। বর্তমানে রাজতন্ত্র ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হইলেও পূজা সমিতি কর্তৃক বহু স্থানে পূজা উপলক্ষে এখনও দরিদ্র জনসাধারণকে অন্ন, বস্ত্র ও অর্থ দান করা হইয়া থাকে। যে সমস্ত দেবদেবীর পূজা অধিক সমারোহের সঙ্গে চলে তাহাদের মধ্যে দূর্গা, শ্যামা (কালী), শিব, সরস্বতী, লক্ষ্মী, রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি প্রধান। দূর্গা এবং কালী শক্তির প্রতীক আর রাধাকৃষ্ণ প্রেমভক্তির প্রতীক। যশোরের ইতিহাসে যে সমস্ত রাজা ও জমিদারের কথা জানা যায় তাহারা অধিকাংশই ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের। তাই দেবী দূর্গা ও কালী পূজার প্রাধান্য দেখা যায়। বৈষ্ণব সমপ্রদায়ের ভক্তগণ রাধা গোবিন্দের পূজায় রত থাকিতেন বা এখনও আছেন। উল্লিখিত মূর্তি ব্যতীত গণেশ, কার্ত্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি মূর্তি পূজিত হইতেন এবং এখনও পূজা পাইয়া থাকেন। এই সমস্ত দেবদেবীর পূজা উপলক্ষে যাত্রাগান, পালাকীর্তন, ভাবগান, কবিগান অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও বা যুবকগণ থিয়েটার করেন। এই সমস্ত যাত্রা, থিয়েটার, কবি, ভাব, কীর্তন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে ধর্ম বিষয়ক অভিনয় ও সঙ্গীত হয়। ইহা হইতে মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করিয়া আদর্শ জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত হন।
পূজা উপলক্ষে বাজার ও মেলা বসে। এই সমস্ত মেলায় দরিদ্র লোকেরা মাটি, বেত, বাঁশ প্রভৃতির খেলনা ও মিষ্টান্ন দ্রব্য বিক্রয় করিয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেন।
উল্লিখিত দেবমন্দিরগুলির মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত এবং কিছু সার্বজনীন। রাজা ও জমিদারদের আমলে তাহাদের বাড়ীতে ব্যক্তিগতভাবে এই সমস্ত মন্দির স্থাপন করিতেন।
মন্দিরের সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি দেবোত্তর হিসাবে রেকর্ডভূক্ত থাকিত। বর্তমানেও কিছু ব্যক্তিগত মন্দির আছে কিন্তু অধিকাংশই সার্বজনীন।
পূজানুষ্ঠান সম্পন্ন করিবার জন্য নিযুক্ত থাকেন ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণগণ সমাজে শ্রেষ্ঠ বলিয়া দাবী করেন। শাস্ত্রানুসারে ব্রহ্মজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিগণ ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হইলেও পুরুষানুক্রমে অনেক অব্রাহ্মণও পূজা পার্বনে পৌরহিত্য করেন। কথা প্রসঙ্গে বলিতে হয় শাস্ত্রানুসারে গুণ, কর্মের বিবেচনায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র ও বৈশ্যেও বিভাজন থাকিলেও পৌরাণিক যুগে গোটা হিন্দু সমাজেই এইরূপ বংশানুক্রমিক পৌরহিত্যের প্রথা প্রচলিত হইয়া গিয়াছিল এবং বর্তমানেও উহা প্রচলিত আছে।
তথ্য সূত্র :
যশোরে হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্য
লেখক : শ্রীতারাপদ দাস
সর্বশেষ আপডেট :
১৫.০৫.১১