
Home ঐতিহ্য (Tradition) > যশোর পৌরসভা (১৮৬৪)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86904 বার পড়া হয়েছে
যশোর পৌরসভা (১৮৬৪)
যশোর শহরের ইতিকথা :
যশোর শহরের শিকড়ের সন্ধান করতে হলে ফিরে যেতে হবে সুপ্রাচীন কালে, খ্রিস্টের জন্মেরও হাজার বছর পূর্বে। মিশরীয় সভ্যতার যখন পুরো যৌবন। BHIKSHU CHAMANLAL এর CRADLE OF CIVILIZATION গ্রন্থ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকে মিশরীয়রা যখন বাংলার বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়েছিল যশোর শহরের প্রতিষ্ঠা তখন। যশোর (ZASOR) এই স্থানিক নামবাচক শব্দটিও ভারতীয় নয়, বরং মিশরীয় শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা এখনো সমপন্ন না হলেও খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের বৌদ্ধ যুগে ভরত রাজা যে দোর্দণ্ড প্রতাপে যশোরে রাজত্ব করতেন তার প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন এখনো বিদ্যমান যশোরের ভরত-ভায়নায়। ঊনিশ শতকের অষ্টম দশকে উইলিয়াম হান্টার তার বিখ্যাত ANNALS OF RURAL BENGAL গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের যে সকল এলাকায় সর্বপ্রথম লোকবসতি শুরু হয়েছিল যশোর তার মধ্যে অন্যতম। শিক্ষাদীক্ষায় সর্বাধিক অগ্রসর জেলাগুলোর মধ্যেও যশোর অন্যতম। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্রের অমূল্য গ্রন্থ ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, যশোরের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ সংঘারাম গড়ে উঠেছিল। শহরের মুড়লী ও কারবালায় দীর্ঘদিন সেই বৌদ্ধ সংঘারামের ধ্বংসাবশেষও ছিল। ধারণা করা হয়, কারবালায় বৈরাম (বোরহান) শাহর মাজারটি ঐ বৌদ্ধ সংঘারামের ধ্বংসস্তুপের ওপর অবস্থিত। এ ছাড়াও মৌর্য্য চন্দ্রগুপ্তের সময়ে গ্রিকদূত মেগাস্থিনিসের গঙ্গরিডি রাজ্যের বিবরণীতে, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর ভ্রমণ বৃত্তান্তে যশোর নামের উল্লেখ আমাদের নিঃসন্দেহ করে যশোরের সুপ্রাচীনত্বকে। একে বঙ্গোপসাগরের লোনাপানি সংলগ্ন ভূভাগ অন্যদিকে ঐতিহাসিক কাল ধরে নদী বিধৌত গ্রাম বাংলার সর্বত্র’র ন্যায় অনাবরত ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যশোর হারিয়েছে যেমন তার আদি মাটি তেমন সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শনসমূহ। তবুও ভাটি-বাংলার মানুষ পুরনোকে ত্যাগ করে চলে যেতে অভ্যস্ত, আবার নতুনকে গ্রহণ করে নতুন সমাজ ও বসতি গড়ে তুলতেও তাদের উৎসাহের অভাব নেই। হয়তোবা সে কারণেই পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, শালবন বিহারের মত জনমানুষহীন ইট-মাটির স্তুপে পরিণত হয়নি যশোর শহর। শত ভাঙ্গাগড়ার মধ্যেও এ শহরে থেকেছে মানুষ-মানুষের সমাজ। আদিকাল হতে ভারতবর্ষের অন্যত্র’র ন্যায় যশোরেও ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রামীণ ব্যবস্থা। এই গ্রামীণ ব্যবস্থার রাজনৈতিক রূপ ছিল আদিম গণতান্ত্রিকতা। যার প্রকাশ ছিল গ্রাম-পঞ্চায়েতী ব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থা স্থায়ী ছিল সু-দীর্ঘকাল ধরে; মোগল শাসনামল পর্যন্ত। আদিম জনসমাজের ঐ কাঠামো চূড়ান্তভাবে ভেঙে যেতে থাকে মোগল শাসনের শেষাংশে ও কোমপানি আমলের প্রথম দিকে। শহরগুলো প্রায় লোপই পায় এবং গ্রামাঞ্চলও খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। এরই এক সন্ধিক্ষণে যখন নাগরিক জীবনের ক্রমবর্ধমান বিভিন্নমুখী চাহিদা, যেমন-ভাল যাতায়াত, পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য রক্ষা প্রয়োজনীয়তার তীব্রতা এই সমস্ত সমস্যার সার্থক সমাধানের স্বার্থে স্থানীয় সংস্থার সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করতে থাকে। তখনই প্রবর্তিত হয় পৌর উন্নয়ন আইন, যশোর শহরে গঠিত হয় যশোর পৌর সমিতি।
শতাব্দী প্রাচীন পৌরসভার অতীত কথা :
শতাব্দী প্রাচীন একটি পৌর শহরের নাম যশোর। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলীয় পুরাতন যশোর রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এই শহরটির অতীত ঐতিহ্য, যশ, খ্যাতি, গৌরব রয়েছে।
১৭৮১ সালে যশোর জেলার প্রত্যক্ষ শাসনভার আসে ইংরেজদের হাতে। কোম্পানি কুঠি ছিল তখন বর্তমান শহরের মাইল দুই পূর্বে মুড়লী কসবায়। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম জেলা শাসক টিলম্যান হেংকেল এই মুড়লীতেই অবস্থান করেন এবং গড়ে তুললেন দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত, জেলা প্রধানের কাছারী, এক হাজার রেজিস্ট্রারের বাড়ি, দপ্তর মোহাফেজখানা আর ছোট একটি কোষাগার। মুড়লীর অবস্থা তখন বেশ জমজমাট। এর পর কেটে যায় অনেকটা সময়। মুড়লীকে কেন্দ্র করে ব্যাপ্তি ঘটতে তাকে যশোর শহরের। পরবর্তীকালে নানা অসুবিধার পাল্লায় পড়ে মিঃ আর্মস্ট্রং বাড়ি সমেত পুরো জমি বিক্রি করে দিয়ে নতুন কাছারী খুললেন বর্তমান শহরের রেজিস্ট্রি অফিসের জায়গায়। আজকের শহরের তুলনায় ছোট এক টুকরো শহর, প্রায় সারা গায়েই তার গ্রামের গন্ধ। জায়গাটি স্যাঁতসেঁতে, আবহাওয়া ও অস্বাস্থ্যকর। যত্রতত্র বনবাদাড়, ঝোপঝাড়, বাঁশ বাগান। তবুও সেখানে সরকারি কাছারীর প্রয়োজনে চার পাশেই গড়ে উঠেছিল বসতবাড়ি। বদ্ধ জলায়; বুড়ি ভৈরবে তখন মশার বসতি, বলা যায় ম্যালেরিয়ার কারখানা। এখানে এসে উইলক আর পার্কার সাহেব অসুখে পড়ে মারা যান। ফলে যশোরের স্বাস্থ্যগত অবস্থার সংবাদ পৌঁছে গেল অনেক দূর। সে সময় এঅবস্থা পাল্টানোর জন্য এগিয়ে এলেন মিঃ বিউফোর্টের নেতৃত্বে অনেকেই। ১৮৫৪ সালে মিঃ ফোর্টের চেষ্টায় প্রথম পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা গড়ে উঠল। সে সময়ের জন্য এ ধরণের পদক্ষেপ ছিল এক স্মরণীয় ঘটনা। এরও দশ বছর পর ১৮৬৪ সালের ১৩ জুলাই বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ঘোষণা অনুসারে ১ আগস্ট থেকে গঠিত হলো যশোর পৌর সমিতি। সে সময় পৌর সমিতির এরিয়া ছিল মূল শহর আর চারপাশের কয়েকটি গ্রাম অর্থাৎ পুরাতন কসবা, ঘোপ, বারান্দীপাড়া, বেজপাড়া, নীলগঞ্জ, খড়কী ও চাঁচড়ার অধিকাংশ। অবশ্য বছরখানেক পরে নীলগঞ্জ, খড়কী, চাঁচড়ার অবশিষ্ট অংশসহ বগচর, মুড়লী ও শংকরপুর যুক্ত হয় পৌর এলাকার সাথে। সব মিলিয়ে মোট আয়তন দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার বর্গ মাইল। যশোর পৌরসভার প্রথম কমিশনার নিযুক্ত হলেন মিঃ টি. টি. অ্যালেন, জে ককবার্ণ, জে. সি. শ’, রাজাবরদাকান্ত রায় বাহাদুর, বাবু আনন্দ মোহন মজুমদার, বাবু মদন মোহন মজুমদার এবং মৌলবী গয়রাতুল্লাহ। পদাধিকার বলে সভাপতি হন জেলাধিপতি মিঃ মলোনী। তখনও গড়ে উঠেনি পৌর সমিতির নিজস্ব অফিস ঘর। সমস্যা দেখা দিল কমিশনারদের সভার জায়গা নিয়ে। সে সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল যশোর পাবলিক লাইব্রেরির পরিচালক মণ্ডলী। ১৮৬৪ সালের ৩১ আগস্ট হতে পাঠাগারেই পৌর সমিতির বৈঠক বসতে শুরু করলো। পরবর্তী সময়ে বাবু আনন্দ চন্দ্র চৌধুরীর একটি বাড়ি মাসিক ১৫ টাকায় ভাড়া নিয়ে ঐ বাড়িতেই পৌর সমিতির দাপ্তরিক কার্যক্রম চলতে থাকে। পৌর সমিতির নিজস্ব ভবন নির্মিত হয় জন্মের তেত্রিশ বছর পর ১৮৭৯ সালে লালদীঘির উত্তর পাশে (বর্তমানের পুরোনো পৌরসভা অফিস)। এর বারো বছর পর যশোর পৌরসভা উপনীত হয় নব পর্যায়ে, কারণ ইতিপূর্বেই স্বায়ত্তশাসনের চেহারা পাল্টাতে যত্নবান হয়েছিলেন কয়েকজন উদারমনা ইংরেজ শাসক। ১৮৭০ সালে লর্ড মেয়ো এর সম্প্রসারণের কাজ অনুমোদন করেন। কিন্তু তা আশানুরূপ ফলপ্রসু হয় না। পরবর্তী সময়ে পৌরসভার নানাবিধ সমস্যা, অব্যবস্থা ও নগর সভার ঘাড়ে বাড়তি ব্যয় ভারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন লর্ড রিপন। ১৮৮২ সালের মে মাসে পৌরসভার প্রসঙ্গে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিলেন তিনি চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের মতা সরকারের হাতে রেখে, পৌর পুলিশের খরচ সরকারি তহবিল থেকেই মিটিয়ে, শিক্ষা, রাস্তা-ঘাট, আলো, জনস্বাস্থ্য, পানি সরবরাহ প্রভৃতি নগর জীবনের প্রয়োজনীয় কাজগুলো পরিচালনার সমগ্র বাস্তবভার নির্বাচিত বেসরকারি চেয়ারম্যান এবং প্রতিনিধিদের হাতে অর্পণ করার জন্যে। অনেক চড়াই-উৎরাই শেষে লর্ড রিপনের প্রস্তাব আংশিক কার্যকর হয়। বিশেষত বাংলাদেশে বিধিবদ্ধ হল পৌর শাসনের নির্বাচনী বুনিয়াদ। ১৮৮৫ সালের ৮ মে, ডাক্তার ব্রাটসন ও বাবু শ্যাম মাধব রায়ের প্রস্তাবক্রমে প্রথম বেসরকারি সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন বাবু পিয়ারী মোহন গুহ। এর আগ পর্যন্ত এই পদে নিয়োগ হত সরকারিভাবে। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা-পা করে সেদিনের যশোর পৌর সমিতি গড়ে উঠেছে ১ নং পৌর সভা থেকে আজকের মডেল টাউনে।
এক নজরে যশোর পৌরসভা :
পৌরসভা সূত্রে : স্থাপিত-ইং ১৮৬৪ সাল, আয়তন-১৪.৭২ বর্গ কিলোমিটার, লোকসংখ্যা-১৬০, ১৯৮/৭৯ (’৯১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী) মোট হোল্ডিং-১২,২০০ (মার্চ ’৯৭ অনুযায়ী) সড়ক-৮৯,৫০ কিঃ মিঃ এর মধ্যে, আরসিসি/সিসি-৩.০০ কিঃ মিঃ, পিচের রাস্তা-৫০৫০ কিঃ মিঃ, খোয়া কনসালিভশন-৬.০০ কিঃ মিঃ, সোলিং/হেরিং বোন বন্ড-১২.১০ কিঃ মিঃ, কাঁচা রাস্তা-১৭.৯০ কিঃ মিঃ, নর্দমা মোট-১০২.১৯ কিঃ মিঃ এর মধ্যে পাকা নর্দমা-১২.৫০ কিঃ মিঃ, কাঁচা নর্দমা-৮৯.৬৯ কিঃ মিঃ, পুল-কালভার্ট-৩৭১টি এর মধ্যে ব্রিজ-৫টি, কালভার্ট-৩৬৬টি, পার্ক-২টি, স্টেডিয়াম-১টি, কবরখানা-৮টি, ঈদগাহ-১টি, মসজিদ-৭০টি, মন্দির-১০টি, চার্চ (গীর্জা)-২টি, রিকসা-৬০০০ খানা, রিকসা ভ্যান-১৫০০ খানা, সড়ক বাতি-১৫০০টি, হস্তচালিত নলকূপ-৫২৪টি, গভীর নলকূপ-১৬টি, ওভারহেড ট্যাংক-৬টি, দৈনিক সরবরাহ-১৮,২০,০০০ গ্যালন, পানির সংযোগ সংখ্যা-৪২৫০টি, স্ট্রিট হাইড্রেন-৭০টি, বাণিজ্যিক স্থাপনা-৩১২৩টি, মোট বস্তির সংখ্যা-১১৫টি, মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা-২৫,০০০ জন, বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পনাধীন বস্তির সংখ্যা-৬টি, বাজার-৬টি, কসাইখানা-১টি, ট্রেনসিং গ্রাউন্ড (ময়লাখানা)-১টি, রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতির সংখ্যা-১৫০০টি, নিয়মিত কর্মচারীর সংখ্যা-১৮০ জন (তন্মধ্যে ১৭ জন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের প্রয়োজনে নিয়োজিত) সুইপারের সংখ্যা ২৭২ জন, শ্রমিকের সংখ্যা-১৭ জন।
যে তথ্য পৌর সভায় নেই :
সড়ক যোগাযোগের রুট-১৮টি, পরিবার-২৯,৭৩৪টি (পরিসংখ্যান ব্যুরো), পুরুষ- ৮৬,০৬৪ জন, মহিলা-৭৪১৩৪ জন, নারী-পুরুষের হার-১১৬.১, অরজ্ঞান সম্পন্ন-৩০.৫৮ জন। ওয়ার্ড-৩টি, মহল্লা-৫৬টি, খ্রিস্ট গোরস্তান-১টি, শ্মশান ঘাট-১টি, কলেজ মোট-৯টি, সরকারি কলেজ-৬টি, বেসরকারি কলেজ-১টি, এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ-১টি, মহিলা কলেজ ১টি, হোমিও প্যাথিক কলেজ-১টি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজিওনাল সেন্টার-১টি, কমার্স কলেজ-১টি, ‘ল’ কলেজ-১টি, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ-১টি, প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-১টি, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল মোট-১৬টি, এর মধ্যে সরকারি স্কুল-২টি, বেসরকারি স্কুল ১৪টি, এর মধ্যে পৌরসভার নিজস্ব ১টি, মাদ্রাসা মোট-১১টি, এর মধ্যে আলীয়া মাদ্রাসা-৩টি, কওমীয়া বা খারেজি মাদ্রাসা-৭টি, মহিলা মাদ্রাসা-২টি, প্রাথমিক বিদ্যালয়-৩৩টি এর মধ্যে সরকারি-২৮টি, বেসরকারি ৫টি, এর মধ্যে পৌরসভার নিজস্ব-৩টি, কিন্ডার গার্টেন-৪৪টি, সঙ্গীত স্কুল-৬টি, আর্ট স্কুল-১টি, এনজিও কার্যক্রম-২৫টি, হাসপাতাল-২টি, ক্লিনিক-২৬টি, পত্র-পত্রিকা মোট-৩৪টি, ডিকেয়ারেশন (DECLARETION) প্রাপ্ত পত্রিকা মোট-১৯টি (জেলা তথ্য অফিস সূত্রে) এর মধ্যে দৈনিক-১০টি, সাপ্তাহিক ৫টি, পাকি-১টি, মাসিক-২টি। হোটেল রেস্তোঁরা মোট-১৩০টি এর মধ্যে আবাসিক-৪৮টি, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট-৩টি, বেকারি মোট-৪৩টি, এর মধ্যে উৎপাদন করে ১৯টি, কনফেকশনারী-২৪টি। আধুনিক সুপার মার্কেট-৮টি, সোনা/রূপার দোকান-১২০টি, সিনেমা হল মোট-৪টি, এর মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত-১টি। জেলখানা (কেন্দ্রীয়) ১টি, মদের দোকান মোট ৯টি, অনুমোদিত-১টি, পাকা পায়খানা-১২,০০০টি, কাঁচা পায়খানা-২০০০’র উপরে। পুকুর মোট-৪’শর উপরে এর মধ্যে পৌরসভার নিজস্ব ৯টি, ডাস্টবিন-৭৫টি, পতিতালয়-৩টি, এর মধ্যে গলি-৬টি। প্রতিদিন গড়ে গবাদি পশু জবাই হয় প্রায় ২০০টি, কসাইখানা খাত থেকে প্রতিদিন পৌরকর আদায় হয় ৩০০-৪০০ টাকা (পৌরসূত্র), পৌরসভার বাৎসরিক আয় ৩,৯৪,৫৭,৫৩৫ টাকা (৯৫-৯৬ অর্থ বছর), পৌরসভার বাৎসরিক ব্যয় ৩,৯৪,৫৭,৫৩৫ টাকা (’৯৫-’৯৬ অর্থ বছর), বাজেট ১৯৯৭-৯৮ ২৫ কোটি ১২ লাখ ২০ হাজার টাকা। দৈনিক পানির চাহিদা কত গ্যালন বলতে পারেনি যেমন পৌরসভা তেমনি জনস্বাস্থ্য বিভাগ, দৈনিক বর্জ নিষ্কাশন হয় কি পরিমাণ এ তথ্যও দিতে পারেনি যশোর পৌরসভা।
পৌর শহর সংলগ্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ :
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড যশোর, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটস, বাংলাদেশ স্কাউটসের আঞ্চলিক অফিস, কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র, যশোর ক্যান্টনমেন্ট, বাংলাদেশ রাইফেল্স যশোর ব্যাটেলিয়ানের সদর দপ্তর, বিমান বন্দর, সরকারী কলেজ ৩টি এর মধ্যে মহিলা কলেজ ১টি, সিনেমা হল ৫টি এবং শিল্প নগরী বিসিক।
ম্যানুয়াল অনুসারে পৌরসভার দায়িত্ব ও কার্যাবলী
বাধ্যতামূলক কার্যাবলী :
১. রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ ও সংরক্ষণ।
২. আবর্জনা সংগ্রহ, অপসারণ ও স্থানান্তর।
৩. রাস্তা আলোকিতকরণ।
৪. রাস্তায় পানি দেয়া।
৫. রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণ।
৬. সংক্রামক ব্যাধি ও মহামারী প্রতিরোধ।
৭. জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ নিবন্ধিকরণ।
৮. কসাইখানা স্থাপন ও সংক্ষরণ।
৯. পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থাকরণ।
১০. ইমারত নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ নিয়ন্ত্রণ।
১১. যানবাহন নিয়ন্ত্রণ।
১২. মেলা ও প্রদর্শনী নিয়ন্ত্রণ।
১৩. বেসামরিক প্রতিরার দায়িত্ব পালন।
১৪. বাধ্যতামূলক শিক্ষা বলবৎকরণ।
১৫. সরকার কর্তৃক নির্দেশিত কার্যাবলী সমপাদন।
ঐচ্ছিক কার্যাবলী :
১. খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ।
২. ব্যক্তি মালিকানাধীন বাজার নিয়ন্ত্রণ।
৩. পায়খানা ও প্রস্রাবখানা স্থাপন ও সংরক্ষণ।
৪. কল্যাণ কেন্দ্র, এতিমখানা, পাগলা গারদ ও বিধবা আশ্রম স্থাপন।
৫. ভিক্ষাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি, জুয়াখেলা উচ্ছেদ।
৬. সমাজ সেবামূলক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন।
৭. ব্যবসা-বাণিজ্যের কার্যক্রম গ্রহণ।
৮. জাতীয় ভাষার উন্নতি।
৯. স্থানীয় ঐতিহাসিক ও বিশেষত্ব সংরক্ষণ।
১০. কমিউনিটি সেন্টার, লাইব্রেরি, আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি স্থাপন।
১১. শরীর চর্চা, খেলাধুলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাকরণ।
১২. গরীব মেধাবী ছাত্রদের সহায়তাকরণ।
১৩. মৃত পশুর নিয়ন্ত্রণ।
১৪. রাস্তা-ঘাটের নামকরণ।
১৫. উদ্যান, পার্ক ও বন স্থাপন।
১৬. মহা-পরিকল্পনা প্রণয়ন (মাস্টার প্লান)।
১৭. এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
১৮. তথ্য কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি।
পৌর এলাকার চালচিত্র :
ঢের থাকলেও আজ তা পরিকল্পনাহীন, যানজট, ময়লার স্তুপ, পয়-প্রণালীহীন, রিকসার শহর হিসেবে অধিক পরিচিতি লাভ করেছে। আজকাল অবশ্য অনেকেই গৌড় রাজ্যের যশ হরণকারী প্রবীণ এই যশোর রাজ্যের পৌর শহরকে সুস্থ জীবনযাপনের অনুপযুক্ত সমস্যার শহরও বলে থাকেন। বর্তমানে প্রায় দুই লাখ লোক বসবাস করছে এই শহরটিতে। লোকসংখ্যার অনুপাতে পানীয় সরবরাহের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বেশিরভাগ রাস্তা ঘাট ভাঙ্গাচোরা। সামান্য বৃষ্টিতেই পাড়া-মহল্লা রাস্তাগুলোতে জমে থাকে হাঁটু পানি। অধিকাংশ রাস্তায় রাতের বেলায় আলো থাকে না। শহরটিতে আবাসিক সমস্যা প্রকট। শহরের মধ্যভাগ দিয়ে ভৈরব নদী প্রবাহিত হওয়ায় বদ্ধ জল নিষ্কাশণের সহজ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সমস্যাটি জেঁকে বসেছে স্থায়ীভাবে। লোকসংখ্যা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মাংশের জন্য কসাইখানা মাত্র একটি। শহরের সোনার দোকানগুলোর বর্জ নিষ্কাশণের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা না থাকায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে প্রতি মূহুর্তে। সমস্যাবলির সমাধান প্রত্যাশায় আন্দোলন হয়েছে অনেক। পৌর অধিকার সংরক্ষণ কমিটি যশোর এখনো আন্দোলন করে যাচ্ছে। যশোর পৌর শহরের অতীত এবং বর্তমান সীমাহীন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই প্রতিবেদন।
হাজারো সমস্যায় আকণ্ঠ ডুবে আছে পৌর এলাকার তিনটি ওয়ার্ডের ৫৬টি মহল্লার প্রায় দুই লাখ নাগরিক। কাঁচা পায়খানা, ড্রেন, রাস্তা, পুকুর, বাড়ির উঠান, খোলা মাঠ পানিতে একাকার হয়ে আছে এলাকার বেশ কয়েকটি মহল্লায়। মল-মূত্র ভেসে গেছে ড্রেনে, পুকুরে, রাস্তায় এমনকি বাড়ির উঠানে। এমনি মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পুকুরে যেমন প্রতিদিন গোসল ও থালাবাসন ধোয়ার কাজ সারছে মহল্লাবাসী তেমনি বাড়ির শিশুরা খেলা করছে উঠানের কাদা পানিতে, দেখার কেউ নেই। অপরিকল্পিত দোকানপাট, বাড়িঘর, ঘরের প্রাচীর নির্মাণ, ড্রেন রাস্তার অবৈধ দখলদারিত্ব, যত্রতত্র গবাদি পশু জবাই, শহরের সর্বত্র অবৈধ মাদক দ্রব্য বিকিকিনি, দগদগে তবিত রাস্তাঘাট, ভাঙ্গাচোরা কাঁচা পাকা অপরিষ্কার ড্রেন, বাতিহীন রাতের সড়ক, ক্রমবর্ধমান চুরি-ছিনতাই, ডাস্টবিনে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ময়লার স্তুপ, শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ব্যস্ততম রাস্তার উপরে গড়ে ওঠা প্রাইভেট, মাইক্রোবাস, স্কুটার ও টেমপুর স্ট্যান্ড, অফিস আওয়ারে শহরের মধ্যখান দিয়ে মালবাহী ট্রাকের অবাধে যাতায়াত, ধারণ মতার অতিরিক্ত হাজার হাজার রিকসা-ভ্যান, সর্বোপরি সীমাহীন যানজট নাগরিক জীবনের জন্য নাভিশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরেজমিনে ঘুরে এবং যশোরের নাগরিক সমস্যার সমাধানে পৌর অধিকার সংরক্ষণ কমিটির লিফলেটে দেখা গেছে, পৌর সভাধীন ৮৯ দশমিক ৫০ কিঃ মিঃ সড়কের ৩০ ভাগই চলাচলের অনুপযোগী। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাড়ে ৭ কিঃ মিঃ রাস্তা। যার প্রায় সবটাতে দগদগে ক্ষতের মত দীপ্যমান। পৌর কর্তৃপক্ষের হিসেবেই ১০২ দশমিক ১৯ কিঃ মিঃ ড্রেনের ১৫ থেকে ২০ ভাগে অবৈধ দখলদারীত্ব কায়েম হয়েছে। বেআইনী দোকানের সারি গজিয়ে উঠেছে এসব ড্রেন জুড়ে। তারপাশে আবার ফুটপাতটুকু দখলে নিয়ে সাইনবোর্ড, দোকানের মালপত্র ঠেসে রাখা হয়েছে। অধিকাংশই ভাঙা ৭৫টি ডাস্টবিনে ময়লার স্তুপ বৈশিষ্টে পরিণত হয়েছে। এই ড্রেন-ডাস্টবিন পরিষ্কারে কারো যেন ভ্রুক্ষেপ নেই। পৌর হিসেবেই যেখানে বৈধ ৬ হাজার রিকসা ও দেড় হাজার ভ্যান শহরে চলাচলের কথা সেখানে চলে ৪ গুণেরও বেশি। শহরের মধ্যভাগ এম.কে রোডে (মিস্ত্রিখানা বা গাড়িখানা) ট্যাক্সি-মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড এবং একটি ট্রান্সপোর্ট অফিস যানজটের তীব্রতাকে ভয়াবহ করে তুলেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৯/১০ টা পর্যন্ত একই রোডে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা একটি আধুনিক হোটেল সুগন্ধা ও অত্যাধুনিক মার্কেট জেস টাওয়ারের নিজস্ব কোন গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা না থাকায় যানজট লেগেই থাকে। এ ছাড়াও অপ্রশস্ত মান্ধাতার আমলের রাস্তার কারণে যানজট আজ নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সদর হাসপাতাল মোড় থেকে দড়াটানা, গাড়িখানা রোড, চিত্রা মোড়, সুগন্ধা হোটেল, জেস টাওয়ার, চৌরাস্তা, আর.এন রোড হয়ে মনিহার চত্বর পর্যন্ত যানজট স্থায়ী হয়ে গেছে। দড়াটানা থেকে হাজী মোহাম্মদ মহসীন রোডের পুরোটাই রাস্তার ওপরে-অবৈধ দোকানপাট বিশেষ করে কাঁচাবাজার গড়ে ওঠায় রাস্তাটি এখন পায়ে চলা পথে পরিণত হয়েছে। তার ওপরে প্রতিদিনের কাঁচাবাজারের আবর্জনা রাস্তার ওপরে ফেলে রাখায় মাসের পর মাস তা জমে থাকা এবং ঐ আবর্জনা রিকসা-ভ্যানের চাকা ও মানুষের পায়ে পিষ্ট হয়ে শুষ্ক মৌসুমে ধুলা এবং বর্ষার সময় পচা কাদায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যেন তা অজপাড়াগাঁর এক মেঠোপথ। অথচ পুরো রাস্তাটি আরসিসি/সিসি ঢালাই ঐ ঢালাই চোখে দেখতে পাওয়া রীতিমত সৌভাগ্যের ব্যাপার। শহরের ৫২৪টি নলকূপের অন্তঃত ১শ’টিতেই পানি ওঠে না। অপ্রতুল দেড় হাজার সড়ক বাতির এক হাজারটিই ১২ মাস নষ্ট থাকে। ফলে সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এই শহর। সমস্ত শহর জুড়ে কসাইখানার চাক্ষুস প্রমাণের পরও হাস্যকর নির্মম সত্যটি হলো পৌর কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কসাইখানা মাত্র একটি। শহরের ৪৮টি আবাসিক হোটেলের অধিকাংশে আজ রমরমা দেহ ব্যবসা জমে উঠেছে। সন্ধ্যার পর শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ বিশেষ করে টাউন হল ময়দান, উন্মুক্ত মঞ্চ, কালেক্টরেট এরিয়া, জর্জকোর্ট ভবন এরিয়া ভাসমান পতিতাদের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। ৫টি সিনেমা হলের দু’টিতে অশ্লীল ছবি প্রদর্শন আজ অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পাহাড় সমান এইসব সমস্যার সমাধান রাতারাতিই হবে না মেনে নিয়ে ক্রমান্বয়ে সমাধানের আকাঙ্খায় যশোর শহরের সকল শ্রেণী/পেশার মানুষের প্রতিনিধিদের নিয়ে গত ১৭ অক্টোবর ’৯৬-এ যশোরের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রে একটা নাগরিক সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৌর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত পৌর কর্তৃপক্ষের সামান্যতম তৎপরতা না দেখে পৌরবাসী হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
তথ্য সূত্র :
প্রকাশিত গদ্য
লেখক : বেনজিন খান
সম্পাদনা :
মোঃ হাসনূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
২৭.১১.০৬